২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তৈরী পোশাক খাত নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন

- প্রতীকী ছবি

নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বৈষম্যমুক্ত জাতিগঠনে এগিয়ে চলা এ দেশের মানুষকে দেখতে হচ্ছে নানা অস্থিরতা। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি তৈরী পোশাক খাতেও তৈরি হয়েছিল অসন্তোষ। দেশের মূলধারার মানুষকে স্বাভাবিক জীবন থেকে সরাতে এ ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। দেশ ও জাতিকে স্বাবলম্বী করতে ভ‚মিকা রাখছে রফতানি শিল্প। আর এ রফতানি শিল্পের বেশির ভাগজুড়ে রয়েছে পোশাক খাতের অবদান। মোট রফতানি আয়ের ৮৬ শতাংশ আসছে পোশাক শিল্প থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কারণে কি বারবার পোশাক খাতে নেমে আসছে কৃত্রিম বিপর্যয়? এমনও প্রশ্ন এখন সচেতন মহলে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো দুলছে।

কয়েক দিন আগে ৫২টি পোশাক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন মালিকপক্ষ। ৫২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৩টি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং বাকি ৯টিতে সাধারণ ছুটির ঘোষণা করা হয়। ২০০৬ সালের ১৩ (১) ধারামতে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ কর হয়। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা শ্রম-অসন্তোষ যদিও আলোচনায় অবসান হয়েছে, তবুও যেন আস্থা ফিরছে না। এর আগেও শ্রমিক অসন্তোষ হওয়ায় কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল। সে সময় কোনো কোনো কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে নিয়মিত বেতন না দেয়ার জোরালো অভিযোগ ছিল।

পোশাক কারখানার মালিকদের তথ্যমতে, আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে এমন কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ৩৩টি বা ৯৫ শতাংশ। বেতন দিতে পারেনি ১১১টি কারখানা বা ৫ শতাংশ। শ্রম-অসন্তোষে এর মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে বলে ১২ সেপ্টেম্বর এই তথ্য জানিয়েছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ঘন ঘন হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ? বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন খাতে বৈষম্য থাকায় তা পর্যায়ক্রমে এ অন্তর্বর্তী সরকার কোনো কোনো খাতে কিছু বৈষম্য দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় পোশাক খাতে তুলে আনা হয়েছে কিছু বৈষম্যমূলক চিত্র। এর মধ্যে মালিকপক্ষের কেউ অন্যান্য সুবিধাসহ ব্যাংক লোনের সুদ মওকুফ পাওয়ার ইচ্ছায় শ্রমিকদের বেতন বাকি রেখে কারখানা বন্ধ রেখেছিলেন। আর তারা ব্যাংকসহ সরকারের ওপর মহলে ধরনা দিচ্ছিলেন। অন্যদিকে শ্রমিকরাও আঁটছিলেন আলাদা কৌশল। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নিয়ে কাজে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হলো।

আমাদের পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিকভাবে রয়েছে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। এ কারণে দেশী-বিদেশী অপশক্তি উপলক্ষ সৃষ্টি করে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে বারবার। ন্যায্য অধিকার আদায়ের নামে কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হলে বা হামলা করা হলে যে শিল্প ধ্বংস হবে, তা সাধারণ শ্রমিকরা কতটা ভাবছেন- এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। তাদের প্রতিবার বোঝানো হয়, তারা শোষিত। তাদের অধিকার নিজেদের আদায় করতে হবে। কিন্তু দাবি আদায়ের ফাঁদে পড়ে যে পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে শিল্প ধ্বংস হতে পারে, সেই সাথে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মপরিধি সঙ্কুচিত হতে পারে- এ বিষয়টা তাদের বোঝায় না কেউ।

এক পরিসংখ্যান মতে, দেশে পোশাক শিল্পে অস্থিরতায় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কয়েকটি রফতানি কারখানায় নতুন করে ৫৪ মিলিয়ন ডলারের আদেশ বেশি পেয়েছে। নয়াদিল্লির বাইরের আরেকটি গ্রুপের মতে, এ চলমান পরিস্থিতিতে স্প্যানিশ ফ্যাশন ফার্ম জারার কাছ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি অর্ডার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যান্ড এই জারা, এইচঅ্যান্ডএম, র‌্যাংলারসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আমাদের পোশাক পণ্যের অন্যতম পুরোনো ধারার ক্রেতা।

পোশাক শিল্পে দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষ আছে চীন। দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের খ্যাতি পোশাকপণ্য যে উচ্চতায় নিয়ে গেছে, তা প্রতিযোগী অন্যান্য দেশ এখনো ঈর্ষার চোখে দেখে। আমাদের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার পোশাকপণ্য রয়েছে। কিন্তু এ দেশগুলো বাংলাদেশের মতো সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া পোশাক শিল্পের বৃহত্তর বাজার আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে চীনের আন্তঃসম্পর্কের অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। সেটা আরো কয়েক বছর আগের কথা। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিশ্বে অবস্থান আগের মতো ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ২২৯টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৯১টি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) মর্যাদাপূর্ণ নিউ প্লাটিনাম সনদধারী। ১২৪টি কারখানা গোল্ড, ১০টি সিলভার মর্যাদা ও বাকি কারখানার সার্টিফায়েড সনদ রয়েছে। শুধু তাই নয়, অবাক করার মতো বিষয়, বিশ্বের সব দেশে পোশাক তৈরিকারকদের যত কারখানা আছে, তাদের মধ্যে ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার ৯টিই বাংলাদেশের দখলে। এ অর্জন জাতিকে বিশ্বজুড়ে গর্বের স্থানে নিয়ে গেছে। তাই ‘মেড ইন বাংলাদেশ লেখা’ পোশাক সারা বিশ্বের নামিদামি ফ্যাশন হাউজগুলোতে অনেক আগে থেকে স্থান করে নিয়ে আজ অবধি অবস্থান ধরে রেখেছে।
আমাদের পোশাক শিল্প একদিনে এত বড় অর্জনের অধিকারী হয়নি। ৪৫ বছরে পথচলায় এ শিল্প নিরন্তর এগিয়ে এসে পৌঁছেছে আজকের পর্যায়ে। দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনৈতিক দেশ ভারত ও পাকিস্তানের রফতানি কমলেও একই সময়ে মানে গত এক দশকে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি বেড়েছে ৮০ শতাংশ। বিশ্বে পোশাক শিল্পে সত্যি বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের।

আরেক পরিসংখ্যান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে এ পোশাক খাত থেকে। এর মধ্যে প্রচলিত বাজারের চেয়ে নতুন বাজারের অগ্রগতি হয়েছে ৩১.৩৮ শতাংশ। এ অগ্রগতিও একটা সম্ভাবনা বহন করে।

দেশের পোশাক খাত এখন আরো বিস্তৃত। এ খাতের প্রধান বাজার ইউরোপ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এর বাইরে জাপান, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, চীন, আরব আমিরাত, মেক্সিকো, সৌদি আরব, তুরস্ক, আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, চিলি ও ব্রাজিল। প্রতিবেশী ভারতেও কিছু পোশাক রফতানি হয়। এক কথায় আমাদের পোশাকপণ্যের বিস্তৃতি এখন বিশ্বের সর্বত্র।

লাখো বেকারের দেশে কর্মসংস্থানেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে পোশাক খাত। বর্তমানে পোশাক খাতে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক কর্মরত। এর মধ্যে ৩০ লাখ নারী। দুই কোটি উপকারভোগী মানুষ এ শিল্পের ছায়ায় অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে। আর এ শ্রমিকদের প্রায় সবাই গ্রামীণ জনপদের। পোশাক কর্মীদের রোজগারে সমৃদ্ধ হচ্ছে তাদের পরিবার। সেই সাথে এর সুবাতাস গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করছে। গ্রামের পরিবার থেকে হাটবাজার- সবখানে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক পরিবার সচ্ছলতার আলোয় আলোকিত হয়ে নতুন নতুন পাকা-আধা পাকা ঘরবাড়িতে সজ্জিত হচ্ছে। অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতি থেকে শুরু করে গ্রামীণ অর্থনীতি পর্যন্ত যখন পোশাক শিল্পের আয়ের প্রভাব, তখন দেশকে বেকায়দায় ফেলতে বারবার শ্রমিক অসন্তোষ আমাদের পথযাত্রা বিঘ্নিত করছে।

সরকারকে ভাবতে হবে, কোনো মালিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেতন বন্ধ রাখেন কিনা? কোনো শ্রমিক গ্রুপ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি করে কিনা? নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পতিত সরকারের সহযোগীরূপে এ শিল্পে স্থবিরতা আনতে এমন ষড়যন্ত্র চালায়? এসব বিষয় তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। কেননা, আজকে পোশাক খাত শান্ত হলেও আগামী দিনে যে অশান্ত হবে না- এ নিশ্চয়তা কে দেবে? কারণ, বারবার হোঁচট খেয়ে অতীত আমাদের এই শিক্ষা দিয়েছে।

আমাদের পোশাক শিল্প নিয়ে এখনই সচেতন হতে হবে। শ্রমিক নেতা, শ্রমিক সংগঠন ও সাধারণ শ্রমিকদের ভাবতে হবে আগামী দিনে কিভাবে ষড়যন্ত্র থেকে এ শিল্পকে বাঁচানো যায়। মালিকপক্ষসহ মালিকদের সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে ভাবতে হবে, ঘাপটি মেরে থাকা কোনো বর্ণচোরা মালিক পতিত সরকারের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বেতনভাতা বন্ধ করছেন কিনা, কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে এ অনিয়ম করছেন কিনা? আর সরকারকে ভাবতে হবে মালিক-শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ কতটা অক্ষুণ্ন রাখা যায়। সেইভাবে উভয়ের স্বার্থরক্ষা করে দেশের ও দেশের মানুষের উন্নয়নের পণ্যকে সব সময় নির্বিঘ্ন করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক
mubarokhosen83@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement