২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নির্বাচন কমিশন কি শপথ ভঙ্গ করেছে

নির্বাচন ভবন - ছবি : সংগৃহীত

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেছেন। একই সাথে পদত্যাগ করেছেন নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: আহসান হাবিব খান, মো: আলমগীর, রাশিদা সুলতানা এবং মো: আনিছুর রহমান।

হাবিবুল আউয়াল কমিশনের সাবেক সিনিয়র সচিব ছিলেন। ইসির সদস্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রাশিদা সুলতানা ছিলেন সাবেক জেলা ও দায়রা জজ, মো: আলমগীর সাবেক সিনিয়র সচিব এবং আনিছুর রহমানও ছিলেন সাবেক সিনিয়র সচিব। তারা ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ পান। তবে আড়াই বছর পর তারা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের নিয়োগদাতা সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। আর সেই সরকারপ্রধান হাসিনা সে দিনই পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। পালানোর জন্য পেয়েছেন ভারত সরকারের অবৈধ ও অযৌক্তিক সহযোগিতা। তিনি তাদের সহযোগিতায় বোন রেহানাকে নিয়ে প্রথমে ভারতের আগরতলা ও পরে দিল্লিতে যান। হাসিনা তার মেয়ের দিল্লির বাসভবনে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে ভারত ছেড়ে তিনি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যেতে পারেননি। কোনো রাষ্ট্র তাকে নিতে সম্মত হয়নি।

এখন প্রশ্ন, সিইসি এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার সারা দেশের মানুষের মতো তাদের নিয়োগদাতা সরকারের পতনের কথা সাথে সাথে জেনেছেন। তাদের বিদ্যাবুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা পরাজিত হাসিনার তুলনায় কোনোভাবেই কম নয়। তার পরও তারা সাথে সাথে পদত্যাগ না করে এক মাস পর পদত্যাগ করলেন। তারা এই এক মাসের বেতন-ভাতা পাওনা হয়েছেন। তাদের পদত্যাগের জন্য জাতির পক্ষ থেকে নানাভাবে দাবিও করা হয়েছে। তার পরও তারা এক মাস পরে পদত্যাগ করলেন কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর তারা জাতিকে জানাননি।

এবার নির্বাচন কমিশনে তাদের নিয়োগ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার মনে হয়। তারা কি সঠিকভাবে নির্বাচন কমিশনার এবং সিইসি পদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন? এক কথায় উত্তর হলো, না, হননি। তারা তৎকালীন সরকারের প্রতারণামূলক অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। জাতি ব্যাপারটি সম্পর্কে সম্যক অবগত। এ ব্যাপারে বোধ হয় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

বর্তমান সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের ৪ নং দফায় আছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। ৫ নং দফায় আছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হইতে পারেন, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণ ব্যতীত কোনো নির্বাচন কমিশনার অপসারিত হইবেন না।’ হয়তো সে কারণে এই এক মাস তাদের অপসারণ করা যায়নি বা সম্ভব হয়নি।

অনুচ্ছেদ ১১৮-তে আরো আছে, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার জন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’

সুতরাং রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করেই সিইসি এবং ইসিদের নিয়োগ দেবেন- এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তা না করলে তিনি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন বলে গণ্য হতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের একটানা ১৬ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কোনোরকম যোগাযোগ ছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন কি না এ ব্যাপারেও কারো কারো মনে প্রশ্ন থাকতে পারে।

এবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনারদের শপথ প্রসঙ্গে আলোচনা সমীচীন মনে হচ্ছে। অন্যান্য সিইসি এবং ইসির মতো পদত্যাগ করা সিইসি এবং ইসিরা শপথ করেছেন এই বলে ‘আমি ... বিশ্বস্ততার সহিত আমার পদের কর্তব্য পালন করিব। আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব, ... আমার সরকারি কার্য সরকারি সিদ্ধান্তকে ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হইতে দিব না।’ এবার এই শপথের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের ব্যাপারে নিঃসন্দেহে সংযত প্রশ্ন এসে যায়, তারা কি বিশ্বস্ততার সাথে তাদের পদের কর্তব্য পালন করেছেন?

তাদের আমলে কি নির্বাচনগুলো সঠিকভাবে হয়েছে? উত্তর নেতিবাচক হলে তারা বিশ্বস্ততার সাথে তাদের কর্তব্য পালন করেননি। তাদের আমলে তাদের পরিচালনায় কোনো নির্বাচন সঠিক হয়েছে বলে কি দেশবাসী মনে করেন? করেন না।

তারা শপথ করেছেন, তাদের সরকারি কার্য সরকারি সিদ্ধান্ত বা ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন না। এই শপথ ভঙ্গের ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়েছে সে ব্যাপারে তারা অসত্য ও প্রতারণামূলক তথ্য জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছেন। তাদের আমলে ভোটের সময় খবাবষ চষধুরহম ঋরবষফ ছিল না। নির্বাচনের সুস্থ, নিরপেক্ষ ও অবাধ পরিবেশ ব্যতীত সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। আর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প প্রতারণায় ভরা কারচুপির নির্বাচন নয়। এ ধরনের নির্বাচন সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সঠিক নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে, তাদের জন্য একটি মাত্র পথ খোলা থাকে, তা হলো- পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পদত্যাগ করা। সদ্য পদত্যাগী নির্বাচন কমিশন তো সে পথে যাননি। তারা যখন বুঝতে পারলেন যে, তৎকালীন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তখন তারা কী করেছেন? তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন।

বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন কিছু অযাচিত পরামর্শ দিয়েছেন। তারা নিজেরা তো এই পরামর্শগুলো অনুসরণ করেননি এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে হাঁটেননি।

হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের ডেকে পদত্যাগ করেছেন। তার লিখিত বক্তব্যে তিনি ১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন বিতর্কিত ছিল বলে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, এবার নির্বাচনের বিতর্কিত সন্দিগ্ধ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তারা তাদের আমলের সব নির্বাচন সতর্কতার সাথে আয়োজনের চেষ্টা করেছেন। তার দাবি- তারা নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুশৃঙ্খল করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং তাদের প্রচেষ্টা নাকি সহায়ক হয়েছে। এটা কি দেশবাসীও মনে করে? তিনি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন?

তিনি বলেছেন, নির্বাচন একদলীয় হয়েছে। তারা যখন দেখলেন, নির্বাচন একদলীয় হতে চলেছে, তখন সে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ তাদের মোটেই ছিল না। বাংলাদেশে একদলীয় নির্বাচন যদি হয়ও তাতে কি দেশের কোনো উপকার হতে পারে। তিনি হয়তো মনে করেছেন, তাতে নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই সফল হবে না। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে তারা সবাই বারবার শপথ ভঙ্গ করেছেন । তিনি বললেন, নির্বাচন একদলীয় হওয়ায় কারচুপি ও সরকারিভাবে প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজন হয়নি। এটা তার অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। দেশের জনগণ তা জানে।

সাংবাদিকদের ডেকে সিইসি এবং ইসিরা পদত্যাগ করলেন, কিন্তু উপস্থিত সাংবাদিকদের কোনো জিজ্ঞাসা আছে কি না জানতে চাইলেন না। তাদের অনেক জিজ্ঞাসা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ তাদের জিজ্ঞাসা নিলেন না। আপনাদের কূট পরিকল্পনা অনুসারে ব্যবস্থা নিলেন। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের ডাকা কি সমীচীন হয়েছে? আপনাদের পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিলেই হতো।

আপনাদের মধ্যে অর্থাৎ সিইসি এবং ইসিদের কোনোরকম দ্বিমত দেখা গেল না। আপনাদের পুরো কার্যকাল আপনারা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করলেন।

আপনারা পাঁচজন পুরো কার্যকাল একই চিন্তাচেতনা এবং হয়তো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পার করেছেন। এটি স্বাভাবিক হয়তো আপনাদের জন্য। কিন্তু স্বাধীন, ন্যায়বান এবং দায়িত্বপূর্ণ পাঁচ ব্যক্তির আড়াই বছর মনে হয় কোনো রকমের দ্বিমত ছাড়া অতিক্রান্ত হওয়ার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, কথায় বলে, পরিশেষে যে কথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে তা হলো, সিইসি এবং ইসিরা সবাই শপথ ভঙ্গ করেছেন। সে জন্য তাদের বিচার হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া ইভিএম কেনাসহ অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনগণের অর্থের লুটপাট এবং অপচয় হয়ে থাকলে সে জন্য বিচারের ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয়। জনগণের প্রতি আপনাদের দায়িত্ব আপনারা কতটা পালন করেছেন- সে ব্যাপারেও উপযুক্ত ও সঠিক তদন্তের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করা আবশ্যক।

লেখক : আইনজীবী
Email : qaagishafique.bd@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement