২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাজধানীর গণপরিবহন ও যানজট

ঢাকার গণপরিবহনকে রক্ষা করার এখনই উপযুক্ত সময় - ছবি : সংগৃহীত

কোনো দাবির পক্ষে জোরালো আর উচ্চকিত আওয়াজ তোলার জন্য সামাজিক মাধ্যম এখন উপযুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম। তবে অসম্পাদিত মাধ্যম বলে মিথ্যাচার কিংবা অরুচিকর নানান কিছুও সামাজিক মাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয়, থাকে অপরকে নিন্দা জানানোর প্রবণতা। এসব থেকে একজন কোনটি নেবেন এবং কতটুকু, সে একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই সমাজ মাধ্যমে একটি দাবি উঠেছে, রাজধানীর যানজট নিরসনের এখনই উপযুক্ত সময়। এই ‘উপযুক্ত সময়’ নিয়ে এক-আধটি বাক্যবন্ধের অবতারণা করতে হচ্ছে। রাজধানীর জনপরিবহনের বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে পরিচালিত এবং সেখানে জনসেবার ছিটেফোঁটা থাকলেও তা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হবে কিন্তু ব্যবসার দিকটি খালি চোখেই দেখা যায়। আদতে বেসরকারি খাতের গণপরিবহন কেবল রাজধানীতেই নয়, সর্বত্র ব্যবসায়ই যেন শেষ কথা। যেকোনো ব্যবসার নানা দিকের মধ্যে জনস্বার্থও সংশ্লিষ্ট থাকে আর সেটি নির্ভর করে দেশের আইন-কানুন পরিপালনের ওপর। রাজধানীর গণপরিবহনে সেটি নেই।

রাজধানীর জন বা গণপরিবহনে বিআরটিসির অংশটুকু বাদ দিলে বাকি সবটাই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দখলে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সরাসরি অংশগ্রহণ কিংবা নেপথ্যে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া পরিবহন ব্যবসায় করা এক রকমের অসম্ভব। এমন দেখা গেছে, ব্যবসায় করছে ‘ক’ কিন্তু কোনো রকমের অর্থের জোগান ছাড়াই মালিকানার অংশে এসে পড়েছে রাজনীতিক ‘খ’। এই ‘খ’ নামক রাজনীতির পেশিশক্তি ব্যতীত ওই এলাকায় পরিবহন ব্যবসায় দুরূহ বলেই এমন হচ্ছে। খবরেই দেখা যায়, রাজধানীর একেকটি বাসটার্মিনল থেকে নিত্যদিন কী পরিমাণ চাঁদা আদায় হচ্ছে এবং এই বিপুল অঙ্কের চাঁদার সাথে রাজনীতিই ওঠে আসে। এখন দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার চলছে এবং রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম থাকলেও জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিকরা কাগজে-কলমে অনুপস্থিত। পরিবহন সেক্টরে বিদ্যমান নেই ১৫ বছরের স্বৈরাচারের দোসররা, যারা সর্বত্র পেশিশক্তির দাপটে হার্মাদ বাহিনী নিয়ে মধু লুটেছে; যার নেপথ্যে সমর্থন জুগিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। রাজধানী কিংবা দেশের পরিবহনে আইনের পরিপালন কিংবা কোনো রকমের সংস্কার করা যায়নি রাজনীতির অন্তরালে বেশে এবং ছদ্মবেশের এই ব্যবসায়ীদের কারণে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে।

রাজধানীর পরিবহনের সাথে যুক্ত কেউ জানে না, এই শহরে হর-সকালে কতজন নিজস্ব পরিবহন ছাড়া গণপরিবহনে কর্মস্থলে যায়। নেই শেষবেলায় কতজন মানুষ বাসে করে বাসায় ফেরে সেই তথ্য। ফলে পরিকল্পিত উপায়ে এখানে পাবলিক পরিবহন চলছে না। সকালে আর শেষবেলায় রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড় দেখলেই কাজে যাওয়া আর ঘরে ফেরাদের দুর্গতি চোখে পড়বে; বিদ্যালয়গামী পড়ুয়াদের অবস্থা আরো খারাপ। একদিকে পরিবহনের স্বল্পতা, আরেক দিকে সব পথে বাস না থাকা এবং অন্যদিকে সেবার নিম্নমান; মোটের উপর মানুষের কষ্টের শেষ নেই। সাথে যুক্ত হয় যত্রতত্র ভাড়া বৃদ্ধি এবং যানজটে সময় নষ্টের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা; আছে বাস শ্রমিকদের খারাপ আচরণ। বলা বাহুল্য, যাদের উপর এই যানজট নিরসনসহ এই সেক্টরের একটু দেখভাল করার কথা, তাদের কাউকে এসব পরিবহনে চড়তে হয় না। তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় না রাজধানীর যানজটে।

এই তথ্য আমাদের আছে, যে একটি আধুনিক শহরে কত ভাগ রাস্তা থাকা আবশ্যক। এটিও জানা কথা, এই রাজধানী ঢাকায় প্রাইভেট গাড়িতে কত ভাগ মানুষ চলাচল করে এবং রাস্তার কতভাগ তারা দখল করে- পক্ষান্তরে বড় যান তথা বাসে কত ভাগ মানুষ চলাচল করছে এবং এই প্রকারের যান রাস্তার কত ভাগ দখল করে। এই তথ্য দিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রস্তাব দেখা যায়, প্রাইভেট গাড়ি হ্রাসের। এটি হলে ভালো, কিন্তু ব্যক্তিপর্যায়ের গাড়ির মালিকানা যে হারে বাড়ছে তাতে এটি বাস্তবায়ন কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কি-না জানিনে। প্রাইভেট গাড়ির চলাচলে লাগাম টেনে ধরার বিরূপ প্রতিক্রিয়াও আছে। এই সাথে সদর তথা বড় রাস্তায় কমগতির রিকশাও একটি বাড়তি বিড়ম্বনা মাত্র (রিকশার ঢাকা ছোট করে দেয়ার নানান আলাপ আছে, অন্য পরিসরে সেই কথা হতে পারে)। লক্ষণীয়, অধিক রাতে রাস্তায় বেরুলে চোখে পড়বে, রাজধানীর অনেকটি সড়ক মোটেই কম প্রশস্ত নয়। দিনের বেলা সড়কের সঙ্কীর্ণতার জন্য দায়ীদের দেখাই যায়। নেই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা। ফুটপাথ আর রাস্তার অংশে ব্যবসায়, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং এবং পুলিশের রাতের চেকপোস্টের বক্সের যন্ত্রণা বড় বড় সড়কেও চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে চলছেই। যানজটের জন্য আরো দায়ী হচ্ছে কথাবার্তা কিংবা স্টপেজ ছাড়াই বাসগুলোর দাঁড়িয়ে পড়া। এমনও হয়, বামদিকে সুপরিসর জায়গা রেখে ডানে এগিয়ে বাস থেমে গিয়ে পেছনের গাড়ির আটকে দিচ্ছে- সবটাই আবার পুলিশের সামনে। একই রুটের দু’টি বাস একই জায়গায় সামনে-পেছনে কেন থেমে থাকবে, বোধগম্য নয়। ব্যাঙ্গালোরে দেখেছি, পেছনে আরো একটি বাস আসা মানেই আগেরটির এক সেকেন্ডও থাকার ফুরসত নেই। যানজটের আর একটি কারণ, ট্রাফিকের দায়িত্বরতদের দক্ষতার সঙ্কটসহ লোকবলের স্বল্পতা। চার রাস্তার মোড়ে দু’জন পুলিশ বাড়াতে পারলে ভালো হয়। বাড়ছে না। লোকবলের নাকি সঙ্কট। কিন্তু বিরোধী দল ঠেঙাতে কিংবা বড় সাহেবদের বাসার বাগানে কাজ করার জন্য কোনো সময়েই পুলিশের ঘাটতি দেখা যায় না। রাজধানীর অতি ব্যস্ততম সড়কেও বলা-কওয়া ছাড়া মোবাইল কোর্ট- যানজটের আরো একটি কারণ। সেই সাথে কতিপয় ভিআইপ এবং পুলিশের উল্টো দিকে চলাচলও বিভ্রাট ঘটায়।

এই দেশে বহু আইন আছে। নেই কেবল আইনের পরিপালন। গণপরিবহনের সর্বশেষ আইনে আছে, রাস্তার কোন অংশ, কত সময়ের জন্য এবং কখন কখন গাড়ি পার্কিং চলবে অথবা ফি দিতে হবে কি না, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। সড়ক বিভাগ, সিটি কর্তৃপক্ষ আর ট্রাফিক পুলিশ সেটি আজো করছে না; বরং সেসব না-থাকায় একটু আগেই গাড়ি পার্ক করা যাচ্ছিল কিন্তু এখন করলেই পুলিশের রেকার সেটি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এই তুঘলকি চলছিল। আগে জায়গা চিহ্নিত করুন; এই জায়গায় পার্কিং চলবে না- তারপর রেকার দিয়ে টেনে নিন, জরিমানা করুন।

এই একটি রাজধানী শহর, যেখানে দু’-চারটি এসি বাস নেই। এই একটি রাজধানী শহরে, যেখানে লক্কড়ঝক্কড় আর রঙচঙহীন বাসেরই আধিক্য। অনেকটার ফিটনেস নেই। ভেতরটা আরো করুণ। কিন্তু চলছেই। চলছে সরকারকে লালচোখ দেখিয়েই; কারণ মালিকপক্ষও সরকার যেন। শহরের বিদ্যমান রাস্তার সম্প্রসারণ করা দুরূহ। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দিয়েই চলতে হবে। শহরের উত্তর-দক্ষিণমুখী এবং পশ্চিম-পূর্বমুখী জনবহুল রাস্তায় আরো বেশি ফ্লাইওভার-এক্সপ্রেস ওয়ের কথাও ভাবা যেতে পারে। মেট্রোরেলের বাকি প্রকল্পগুলো নিয়েও ভাবার সময় এখনই। আগের সরকার করছে বলেই বাদ দিতে হবে; তাও নয়। আবার মেট্রোর নাম থাকলেই বাস্তাবায়ন করতে হবে; তাও নয়। এই নিয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা শ্রেয়তর।

একটি দেশের রাজধানী শহর দেশটির নাগরিকদের গর্বেরই জায়গা। সব দিক থেকে ঢাকাকে সেভাবে গড়ে তোলা তো অন্যতম নাগরিক দাবি। কিন্তু ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে নাগরিক-গর্বের পরিসরটা ক্রমেই ছোটই হচ্ছে যেন। একজন বিদেশী এয়ারপোর্ট নেমেই যানজট আর গণপরিবহনের দুরবস্থা থেকে আমাদের সম্বন্ধে প্রথমেই নাসিকা কুঞ্চিত করে; পুন ফ্লাই করার আগে সেই নাক আর ঠিক হয় না। ঠিক- অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতিপয় পদক্ষেপ নিতেই পারে; যা পূর্বতন সরকার নিজেদের রাজনীতিক-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিতে অপারগ ছিল। বাস-ট্রাকের দুর্বিনীত-দুর্নিবার চালকদের নিয়ন্ত্রণ করুন। ফিটনেসহীন এবং লক্কড়ঝক্কড় মার্কা পুরনো বাস বাই ফেজ তুলে দেয়ার বন্দোবস্ত করুন। যত্রতত্র গাড়ি পার্কি এবং বাসের স্টপেজ দেয়া নিয়ন্ত্রণে নিন। ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে তাদের দক্ষ করে তুলুন- দরকারে, বড় সাহেবদের বাদ দিয়ে তাদের বিদেশ দেখিয়ে আনুন। কোনো রকমের কারণ ব্যতিরেকে রাস্তার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি রোধ করুন। রাস্তার দু’ধার আর ফুটপাথ থেকে ব্যবসায় সরিয়ে দিন। সর্বশেষ আইনমতে প্রাইভেট গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা চিহ্নিত করুন। চলমান ভিড়ের মধ্যে মোবাইল কোর্ট নিষিদ্ধ করুন। এর পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেস ওয়ে ও মেট্রোরেল বানাতে হবে; তবে এসব করতে সময় লাগবে। এই সাথে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিকে আরো শক্তিশালী করে রাজধানীতে এসি বাসসহ বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন। এসব পদক্ষেপ সবটাই বিদ্যমান রাস্তায় করা সম্ভব; এর জন্য নতুন পরিকাঠামোর দরকার হবে না। রাজনৈতিক মালিকরা এখন এসব সহজেই মেনে নেবে বলেই অনুমেয়। ফলে অন্তর্বর্তী সরকার এদিকে একটু মনোনিবেশ করতেই পারে। রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনকে রক্ষা করার এখনই উপযুক্ত সময়; চেপে থাকা কিছু জঞ্জাল তো সাফ করাই যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই দাবিই আমাদের।

লেখক : অতি. সচিব (অব.) ও এবং কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement