২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ব্যাংকে তারল্য সঙ্কট ও খেলাপি ঋণ

- সংগৃহীত

ইলিয়াস মিয়া পাঁচ লাখ টাকার চেক নিয়ে ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কপালে তার চিন্তার রেখা, কতক্ষণে টাকা তুলতে পারবেন। মহিলা ক্যাশ অফিসারকে চেকটা দেয়ামাত্র অফিসার তার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার পাঁচ লাখ টাকা তো আজ দেয়া যাবে না, আজ তিন লাখ নেন, কালকে বাকি দুই লাখ নিয়েন। ভদ্রলোক একটু জোর গলায় বললেন, আমার টাকা আমাকে দেবেন, তাড়াতাড়ি করেন। অফিসার আবার বললেন, স্যার, আপনি যদি আমাকে হেল্প করেন তাহলে অন্য গ্রাহক ভাইকেও কিছু টাকা দিতে পারব। এ মুহূর্তে নগদ টাকা শাখায় কম আছে, যা আছে তা সবাইকে দেয়ার চেষ্টা করছি।

ইদানীং ব্যাংকগুলোতে সচরাচর এমন সব কথাবার্তা শোনা/দেখা যাচ্ছে। কারণ ব্যাংকে নগদ টাকার ঘাটতি বা তারল্য সঙ্কট রয়েছে। ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোয় তারল্য সহায়তা বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কলমানি মার্কেটেও লেনদেন বেড়েছে। এ বাজার থেকেও ব্যাংকগুলো ধার নিচ্ছে। এ ছাড়া এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি আমানতও নিচ্ছে। এর বাইরে আমানতের সুদহার বাড়িয়ে বাড়তি আমানত সংগ্রহের উদ্যোগও নিয়েছে। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কট মোকাবেলার বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এখন ১১টি ব্যাংক তীব্র তারল্য সঙ্কটে পড়েছে। সঙ্কটের কারণে এসব ব্যাংক গ্রাহকদের নিয়মিত চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না। এতে গ্রাহকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। ৫ আগস্টের আগে বিগত সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওইসব ব্যাংককে বিশেষ অর্থের জোগান দেয়া হতো। নতুন সরকার এসে সে সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে আর কোনো সুবিধা দেয়া হবে না। ব্যাংকগুলোকে তারল্যের জোগান নিতে হলে তাদের কাছে থাকা বিভিন্ন ট্রেজারি বিল বা বন্ড বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হবে। কিন্তু ১৩ ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বন্ধক রাখার মতো ট্রেজারি বন্ড বা বিল নেই। যে কারণে তারা ওইসব বিল-বন্ড বন্ধক রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহায়তা নিতে পারছে না। এতে ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট আরো বেড়েছে। আলোচিত এস আলম গ্রুপের দখল করা সব ক’টি ব্যাংকেই তারল্য সঙ্কট চলছে। ওই সব ব্যাংকে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছে।

ঋণের নামে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হয়েছে। সম্প্রতি এসব ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। এর মধ্যে দেশের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসিরও আমানতপ্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। গত আগস্ট মাসেও সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আসে এ ব্যাংকের মাধ্যমে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন গভর্নর আন্তঃব্যাংকে লেনদেন আবার সচল করার উদ্যোগ নেন। কিছু ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক থেকে ধার দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, তারল্য সঙ্কট নিরসনে ব্যাংকগুলো পরস্পরকে ধার দিতে পারে, এতে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টি দিতে প্রস্তুত রয়েছে। আর্থিক খাতে ঋণ জালিয়াতি ও ব্যাপক মাত্রায় অর্থ পাচার ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ অত্যধিক হারে বৃদ্ধি তারল্য সঙ্কটের অন্যতম কারণ। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সাড়ে ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ যে কী পরিমাণ বেড়েছে, তা রীতিমতো এক ভয়ঙ্কর চিত্র। এই সময়ে শুধু ব্যাংক খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশই আদায় অযোগ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে বিতরণকৃত মোট ঋণ ছিল ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ফলে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি। তিন মাস আগে মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট বিতরণ করা ঋণের ১১.১১ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৯৬ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ফলে দলটি টানা তিন মেয়াদ ও সাত মাস ক্ষমতায় থাকার সময় খেলাপি ঋণ দফায় দফায় বেড়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কারে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এরমধ্যে ৯টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে, যার বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ ছিল এস আলম গ্রুপের হাতে। পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে নানা নির্দেশনাও দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র ক্রমান্বয়ে বেরিয়ে আসছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ মূলত চার লাখ কোটি টাকা থেকেও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ও পত্রিকার তথ্য থেকে দেখা যায় রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এক লাখ দুই হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশই খেলাপি।

রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মধ্যে তালিকার শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক, যাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রধানত বড় তিনটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কারণে। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৮ হাজার কোটি টাকা, অ্যানন টেক্স গ্রুপের প্রায় আট হাজার কোটি টাকা এবং এস আলম গ্রুপের দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে এবং সে মোতাবেক প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য যেসব আন্তর্জাতিক মানের রীতি প্রচলিত ছিল, তার বেশির ভাগই সংশোধন বা পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। যেমন- ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা ও পুনঃতফসিলীকরণ নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। আগে গোষ্ঠীভুক্ত কোনো একটি প্রকল্প ঋণখেলাপি হলে গ্রুপের অন্যান্য প্রকল্পে ঋণদান করা হতো না। এ বিধান বাতিল করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ঋণখেলাপি হওয়ার প্রবণতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে সহায়ক অথবা আদায় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিয়েছে এমন আইনগুলো পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে আরো কঠিন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে।

তারল্য সঙ্কট ও খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়াসহ অন্য অনেক সমস্যার মূলে রয়েছে এ খাতের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব। এ খাতের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের বিষয়টিতে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কারণ যারা এটা দেখভাল করার কথা তারা নিজেরাই ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই একটি বা দু’টি বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে কোনো লাভ হবে না। ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে সংস্কারের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে খাতটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে এক লাখ ১৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। কিন্তু সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা। এর মানে প্রয়োজনের তুলনায় ২৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা সামগ্রিক ঘাটতি হয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা ও রিকভারি জোরদার করা উচিত।

ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন এবং খেলাপি ঋণের ক্রমাগত বৃদ্ধি থেকে মুক্তির জন্য প্রথমত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং ব্যাংকিং সেক্টরের যে নীতি, বিধি ও প্রজ্ঞাপন রয়েছে তা সঠিকভাবে পরিপালন করা হলে এ খাতের যে সমস্যা তা দূর হতে বাধ্য। খেলাপি ঋণের বিষয়ে অনেকে আলোচনা করছেন, পত্রপত্রিকায় সমালোচনাও করা হচ্ছে, কিন্তু এ থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে, কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে আমরা সুষম ও টেকসই করতে পারি- সে বিষয়ে ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ জন্য সর্বপ্রথম আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন দরকার। সমস্যা কারা তৈরি করছে, কিভাবে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এসবই ব্যাংকিং সেক্টরের অভিজ্ঞজনরা জানেন, রাজনীতিবিদরাও কম জানেন না। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায়, ব্যাংক আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে, সর্বোপরি দেশের আর্থসামাজিক উন্নতিকল্পে নিরপেক্ষভাবে ব্যাংকিং নীতিমালাগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন করা হলে খেলাপি ঋণের কুপ্রভাব থেকে সেক্টরটি মুক্ত হতে পারে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক
ইমেইল : main706@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement