২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

অটিজম প্রতিরোধে করণীয়

অটিজম প্রতিরোধে করণীয় - সংগৃহীত

অটিজম শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে আগত, যার অর্থ- আত্ম বা নিজ থেকে এসেছে। শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন সুইস মনোবিজ্ঞানী চিকিৎসক অয়গেন বয়লার। অটিজম দিয়ে শিশুর মানসিক সমস্যা বোঝানো হয়। অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যার একটি বিস্তৃত রূপ বা অটিজ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার নামে পরিচিত। এখানে স্নায়ু শব্দটি স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সাথে স্নায়ুর সম্পর্ক বোঝায়। অটিজম উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আর সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ইদানীং অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ১৯৯০ সালে এদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ হাজারে একজন ছিল। ২০০৯ সালে ১৫০ জনে একজন এবং এরপর প্রতি ১০০ জনে একজন অটিস্টিক ছিল। সম্প্রতি এক গবেষণায় জানা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরে অটিস্টিক শিশু জন্মের হার বেশি। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪টি শিশু এবং শহরে ২৫টি শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াইগুণ বেশি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।
ধারণানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর তার সাথে যোগ হচ্ছে আরো প্রায় দেড় হাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। এটি মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত মানসিক রোগ। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা, তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকতে পারছে, কেউ বা নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারে। এসবই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সাফল্য বলে খুশি থাকতে হবে। এ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর জন্য কেবল মাকে নয়, বাবাকেও সময় দিতে ও সহযোগিতা করতে হবে। জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুলে সপ্তাহে অন্তত এক দিন বিশেষ শিশুদের জন্য সুযোগ রাখা প্রয়োজন। বিশেষ শিশুদের অভিভাবকদের অবশ্যই কাউন্সেলিং দরকার। কারণ এই শিশুদের অভিভাবকরা ভালো থাকলে তাদের সন্তানটিও ভালো থাকবে। আর অটিজম শিশুদের এমন একটি মানসিক রোগ যাতে তারা কথা, কাজ-কর্ম বা খেলাধুলা ইত্যাদির মাধ্যমে অন্য শিশুদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে পারে না। কেবল শিশু নয়, বড়দের সাথেও তারা সম্পর্ক গড়তে পারে না। মোট কথা, এরা সামাজিকতা আয়ত্ত করতে পারে না। সারাক্ষণ নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সদা সর্বদা কল্পনার এক অবাস্তব জগতে ডুবে থাকে তারা। নানা রকমের কাল্পনিক শব্দ শোনে, কাল্পনিক দৃশ্য দেখে। কিছু বিষয়কে তারা খুবই পছন্দ করে এবং দিন-রাত সেগুলো নিয়েই পড়ে থাকে। আবার কিছু বিষয়কে তারা ভয় পায়, সহ্য করতে পারে না। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের বিচার-বুদ্ধির কোনো উন্নতি হয় না। ডাক্তারি ভাষায় এদেরকে বলা হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা কোনো একটি বিষয়ে অত্যধিক ঝোঁকসম্পন্ন শিশু। সাধারণভাবে এদেরকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে গণ্য করা হয়। শেষ কথা হলো, সারা জীবনই পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য তারা একটি বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। তার চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তাররা এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা অটিজমের কোনো কার্যকর চিকিৎসা নেই বলে ঘোষণা দিয়ে থাকেন। ফলে অভিভাবকরা হতাশ হয়ে সন্তানের রোগমুক্তির আশা ত্যাগ করেন। অপদার্থ সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া মা-বাবার আর কিছুই করার থাকে না। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, উপযুক্ত হোমিও চিকিৎসা অবলম্বন করলে খুব সহজেই অটিজম আক্রান্ত শিশুদেরকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। হোমিও চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং হোমিও ডাক্তারদের লেখায় অটিজমের অগণিত কেস হিস্ট্রি দেখা যায়, যাদেরকে তারা সফলভাবে রোগমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন।

ব্রিটিশ হোমিও চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা: বার্নেট লিখেছেন, আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে তিনি এমনকি মধ্যবয়স্ক অটিজমের রোগীকেও সুস্থ করতে সক্ষম হয়েছেন। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, ডিপিটি, পোলিও, হাম, হেপাটাইটিস, এমএমআর প্রভৃতি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শিশুরা অটিজমে আক্রান্ত হয়। পক্ষান্তরে টিকার বিষক্রিয়ায় যেসব রোগ হয়, তাদের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের সাফল্য একটি ঐতিহাসিক সত্য।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার কম্পিউটার বিজ্ঞানী এমি ল্যানস্কির শিশুসন্তান যখন অটিজমে আক্রান্ত হয়, তখন বিশ্বখ্যাত সব সাইক্রিয়াট্রিস্ট, নিউরোলজিস্টরা কয়েক বছর চেষ্টা করেও তাকে সুস্থ করতে ব্যর্থ হন। তারা ঘোষণা করেন, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই; কিন্তু এমি ল্যানস্কির বিশ্বাস হয়নি যে, দুনিয়াতে অটিজমের কোনো চিকিৎসাই নেই। পরে স্থানীয় একজন বিশেষজ্ঞ হোমিও চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা নিলে শিশুটি অটিজম থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পায়।

ওই ঘটনার পর এমি ল্যানস্কি নাসার চাকরি ছেড়ে দিয়ে হোমিওপ্যাথির ওপর একটি ডিপ্লোমা কোর্স করে বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার অটিজম-সহ দুরারোগ্য রোগব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় আত্মনিয়োগ করেছেন।
অটিজমে আক্রান্ত শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে অসুবিধা হয়। কথাবার্তা, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকে আবার অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মানসিক ও ভাষার ওপর দক্ষতা কম থাকে। সাধারণত ১৮ মাস থেকে তিন বছর সময়ের মধ্যেই এই রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়।

অটিজমে আক্রান্ত শিশু কথা বলতেও পারে আবার একদম নাও বলতে পারে। আবার কথা বললেও হয়তো ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না।

অটিজম কেন হয়
অটিজমের নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। পরিবেশগত ও বংশগত কারণেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত জটিলতা, লক্ষণ অথবা তীব্রতার ওপর নির্ভর করে এর কারণগুলো বিভিন্ন হতে পারে। কী কী কারণে অটিজম হতে পারে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সতর্ক হলে অটিজম প্রতিরোধ সম্ভব হতে পারে।

চিকিৎসকদের মতে, ভাইরাল ইনফেকশন, গর্ভকালীন জটিলতা এবং বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো অটিজম হওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। জিনগত কারণেও অটিজম হতে পারে। জেনেটিক বা জিনগত সমস্যা বংশগতও হতে পারে আবার নির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াও হতে পারে।

অটিজমের সাধারণ লক্ষণ
অটিজমের লক্ষণগুলো সঠিকভাবে জানার মাধ্যমে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সাধারণত যে লক্ষণগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হলো :
অটিস্টিক শিশুদের ঘুমের সমস্যা থাকে। ঘুম স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে তাদের মনোযোগ ও কাজের সক্ষমতা কমে যায় এবং আচার আচরণে সেটি পরিষ্কার বোঝা যায়।

অনেক অটিস্টিক শিশুর মধ্যে অল্প মাত্রায় হলেও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা লক্ষ করা যায়। অনেক শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না। অনেক শিশু দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ অথবা স্পর্শের প্রতি অতি সংবেদনশীল অথবা প্রতিক্রিয়াহীন থাকতে পারে। সাধারণত অটিস্টিক শিশুদের প্রতি চারজনে একজনের খিঁচুনি সমস্যা হতে পারে।

অটিস্টিক শিশুদের মানসিক অস্থিরতার ঝুঁকি বেশি থাকে। এসব শিশুর বিষণœতা, উদ্বিগ্নতা ও মনোযোগে ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাদের প্রায়ই হজমের অসুবিধা, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের গ্যাস, বমি ইত্যাদি হতে পারে।

অটিজমের প্রধান লক্ষণ
ছয় মাস বা তার বেশি বয়সে স্বতঃস্ফূর্ত হাসি বা যেকোনো আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। ১২ মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো কথা না বলা সেই সাথে ইশারা বা হাত বাড়িয়ে কিছু চাইতে বা ধরতে পারে না। চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারে না। ভিড় এড়িয়ে একা থাকতে পছন্দ করে। অন্যের অনুভূতি বুঝতে পারে না। একই নিয়মে চলতে পছন্দ করে। একই শব্দ বারবার বলতে থাকে বা একই আচরণ বারবার করে যেমন- একইভাবে হাত বা মাথা নাড়ানো। বিশেষ রঙ, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ বা স্বাদের প্রতি কম বা বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হয়। কোনো বিষয় বা বস্তুর প্রতি অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখায়।

অটিজম প্রতিরোধে করণীয়
সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারে কারো অটিজম অথবা কোনো মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম, শিশুর সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আরো কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- বেশি বয়সে সন্তান না নেয়া। সন্তান নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভ্যাকসিন দিতে হবে।

অটিজমের হোমিও সমাধান
প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করা যায়। অভিজ্ঞ রেজিস্টার্ড হোমিও চিকিৎসকের কাছ থেকে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগে চিকিৎসা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। পরিশেষে বলতে চাই , আসুন আমরা সবাই অটিজম সম্পর্কে সচেতন হই। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায় মায়ের প্রতি যত্নবান হই। যেসব সমস্যার কারণে শিশুর অটিজমসহ অন্যান্য রোগের সৃষ্টি হতে পারে, সেসব কারণ সম্পর্কে সচেতন হই। সেই সাথে পরিবার সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে অটিজম আক্রান্ত শিশুর প্রতি সমবেদনা ও ভালোবাসা সৃষ্টি করি। তাহলেই অটিস্টিক শিশু বা ব্যক্তি এই সুন্দর পৃথিবীতে তার বেঁচে থাকার উপলক্ষ পাবে।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
ইমেইল : drmazed96@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
প্রধান উপদেষ্টার সfথে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাটমোহরে গৃহবধূর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় জনতার হাতে এসআই আটক সাবেক আইনমন্ত্রী-সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল-তাপসসহ ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা ‘খালেদা জিয়া: এ বায়োগ্রাফি অব ডেমোক্রেসি’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন হিলি স্থলবন্দরে ভারত থেকে আবারো আলু আমদানি শুরু শেখ হাসিনাকে কি বাংলাদেশের হাতে তুলে দেবে ভারত? আরো ২ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলো আনিসুল, সালমান, দীপু মনি ও পলককে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কথিত জমাতুল আনসার সদস্যদের জামিন বাতিল তথ্য সংশোধন ও সংযোজনের জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের খসড়া তালিকা প্রকাশ এক দিনের ব্যবধানে আবারো বাড়ল স্বর্ণের দাম অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজনে সহায়তা দিতে প্রস্তুত জাপান : রাষ্ট্রদূত

সকল