২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ প্রসঙ্গে

-

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূস গত ৮ আগস্ট শপথ নেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানান। দুই দেশের মানুষের ‘স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে’ একযোগে কাজ করতে ভারত যে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবে, ওই পোস্টে সে কথাও জানান মোদি।

নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নতুন বাংলাদেশকে বুঝতে আগ্রহী যে, ‘আয়রন লেডি’ হিসেবে নিজের ভাবমর্যাদা গড়ে তোলা শেখ হাসিনা কেন এত দ্রুত ক্ষমতায় তার দখল হারান। সেই সাথে বাংলাদেশের পরিবর্তনের ধরনটিও বুঝতে চায়। ২০০৯ থেকে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করেছেন, নির্মমভাবে সব বিরোধী দলকে চূর্ণ করেছেন। একজন নেত্রী গণতন্ত্রের মাধ্যমে কিভাবে স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হলেন, তার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা কি তা ভালো করে বোঝার একটি গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছে।

ভারত বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে শুধু হাসিনা সরকারের সাথেই তাদের সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। এটিই ভারতকে সবচেয়ে বেশি বিপাকে ফেলেছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর এখন দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে হবে। ভারতে বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে বিস্তর আলাপ উঠেছে। দিল্লি এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে, কিভাবে তারা ঢাকার সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ ও উন্নয়ন করবে। বাংলাদেশের জনমনে ভারত-বিরোধিতা তুঙ্গে থাকায় দিল্লিকে এ বিষয়ে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কিন্তু বুদ্বিজীবী মহলে যে প্রশ্নটি বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল তা হলো- বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে ছাত্রসহ নতুন জেনারেশন কিভাবে ভারতবিরোধী হয়ে উঠল।

শেখ হাসিনা চিরকাল ঢাকার ক্ষমতায় থাকবেন না, এটি জানা থাকলেও সেই দিনটি যে এত তাড়াতাড়ি আসবে ভারত তা ভাবতে পারেনি। কিন্তু মোদি সরকার না বুঝলেও ভারতের মিডিয়া আগেই তা আঁচ করতে পেরেছিল।

দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখতে চাই। প্রতিবেশী দেশগুলোর একে অপরের নির্ভরশীলতার উপর জোর দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত ১৭ সেপ্টেম্বর এনডিটিভিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১৫ দিন আগের কথা। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট বিতর্কিত কোটা পদ্ধতি বাতিল করার ঠিক পরদিন দিল্লিতে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় শিরোনাম ছিল- ‘ডিসটার্বিং ইন ঢাকা’। ওতে লেখা হয়েছিল- “কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে, তা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী রাজনীতিরই উপসর্গ। বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের বাংলাদেশ নীতি ও শেখ হাসিনা যেভাবে প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল, তাতে দিল্লির মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকটি ভারতকে ‘বিয়ন্ড হাসিনা’ ভাববার পরামর্শ দিয়েছিল। এমতাবস্থায় ঢাকায় নাটকীয় পটপরিবর্তনের মাধ্যমে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে কী কৌশল নিয়ে এগোবে তা ভারত চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে।”

গত প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে একটি প্রধান অভিযোগ ছিল, তারা শুধু শাসক দল আওয়ামী লীগের সাথেই সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং ‘আওয়ামী লেন্স’ দিয়েই বাংলাদেশের সব কিছু দেখার ও মূল্যায়নের চেষ্টা করেছে।

ভারত তার নিজের নিরাপত্তা সুসংহত করার জন্য শুধু আওয়ামী লীগের মতো কোনো একটি দলের সাথে সম্পর্কিত না হয়ে দেশের মানুষের সাথে সম্পর্কিত হলে সম্পর্কের এমন বিপর্যয় হতো না। এখানে ভারতের উদ্যোগে আওয়ামী লীগকে বোঝানো দরকার ছিল যে, বাংলাদেশে একটি কার্যকরী বিরোধী পক্ষ, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকলে দ্রুত তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। সে ক্ষেত্রে ভারত তার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হবে। এমন হলে আওয়ামী লীগ চরম কর্তৃত্বপরায়ণ হতো না। ভারত বাংলাদেশে তার স্বার্থ খুব সহজেই দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে পারত। তাতে সম্ভবত বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ভারত কী কৌশলে এগোবে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, দিল্লি সেটি ভাবতে আবার ভুল করছে কি না সেটিও ভারতকে খুব ভালো করে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ইসলামোফোবিয়া প্রভাবিত তাদের বাংলাদেশ-নীতি বিগত দিনগুলোতে ঠিক ছিল কি না এবং হয়ে থাকলে তা নতুন করে পুনর্বিবেচনা করতে হবে কি না, তাও রিভিউ করতে হবে।

ভারতের নিজের বৃহত্তর ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকলেও বাংলাদেশের বৃহত্তর ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা কোন সমীকরণে ভারতের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায় তা আমাদের বোধগম্য নয়। এসব পুনর্বিবেচনায় এটিও সঠিকভাবে নিরূপিত হতে পারবে যে, সমতাভিত্তিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা, করণীয় এবং ন্যায্যতার মাধ্যমে অবশ্যই সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।

দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় গবেষক ও মিডিয়া এমন একটি বর্ণনার দিকে এগোচ্ছে যে, এই পরিবর্তনটি বাংলাদেশকে মুসলিম মৌলবাদের দিকে ধাবিত করবে। একই সাথে তারা বাংলাদেশের হিন্দুদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে বলেও প্রচার করছে। যদিও বিবিসির অনুসন্ধানে তার বেশির ভাগই গুজব ছিল বলে প্রমাণিত।

আসলে ইসলামী দলগুলো বা বিশেষ করে প্রধান ইসলামী দল জামায়াতের রাজনৈতিক বা ধর্মীয় মতাদর্শ ভারতের কাছে এতটাই ‘অস্পৃশ্য’ যে, জামায়াতের কোনো রাজনৈতিক সঙ্গী বা শরিককেও বিশ্বাস করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়- মোটামুটি এ যুক্তিটিই দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক সার্কিটে ও অ্যাকাডেমিয়াতে এত দিন ধরে দেয়া হতো।

কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলে তার জায়গায় একটি পাকিস্তানপন্থী সরকার আসবে- এই বয়ান সঠিক নয়। বাংলাদেশের বর্তমান মনোস্তাত্তি¡ক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ভারত তাদের বয়ান, তাদের চিন্তা পাল্টাবার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশে একটি গভীর মনোস্তাত্তি¡ক পরিবর্তন হয়েছে। এমতাবস্থায় বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসেছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ছোট-বড় নির্বিশেষে সবাইকে এককাতারে অন্যায়ের বিরুদ্বে বিদ্রোহের দৃঢ় প্রত্যয়ের পতাকাতলে সমবেত করেছে। মাদরাসার ছাত্ররা, ইংরেজি ভাষার ছাত্র নির্বিশেষে সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাতারে শামিল করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটি মনোস্তত্ত্ব ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগেষ্ঠীকে এককাতারে, এক পতাকাতলে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করতে সহায়তা করেছে। এর ফলে ভারত তাদের নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থরক্ষা করতেই বাংলাদেশের সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর কাছেই তাদের সমতাভিত্তিক সম্পর্ক তুলে ধরতে পারে। ভারতের জন্য এটি ভুল শোধরানোর একটি সুবর্ণ সুযোগও বটে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ড. ইউনূসের তাৎক্ষণিক বক্তব্য থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়। তার শপথের পরই তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোনকলের মাধ্যমে শুভেচ্ছা জানান। এর পর ড. ইউনূস বলেছেন, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক করতে আগ্রহী বাংলাদেশ। ৮৪ বছর বয়সী ড. ইউনূস বলেন, আমরা চাই বিশ্ব বাংলাদেশকে একটি সম্মানিত গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

ভারতকে উদ্দেশ করে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সবাই ইসলামপন্থী, বিএনপি ইসলামপন্থী এমন ধারণা থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের সবাই ইসলামপন্থী এবং (তারা) এই দেশটিকে আফগানিস্তানে পরিণত করবে, বের হতে হবে এমন ধারণা থেকেও। আর বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই নিরাপদ, পরিবর্তিত বিশ্বে এমন ধারণা একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশের চিন্তার দৈন্য প্রকাশ করবে। এসব ধারণা থেকে ভারতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ হবে অন্য প্রতিবেশীর মতোই একটি প্রতিবেশী দেশ।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, দিল্লি এখন বোঝার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশের সরকারে কাদের প্রভাব বেশি। ভারতকে নতুন অন্তর্র্বর্তী সরকারের সাথে তড়িঘড়ি সম্পর্কের সেতু তৈরি করতে হচ্ছে। ফলে নতুন সরকারের সাথেও ভারতের ‘স্বার্থ’ কোথায় কোথায় মিলতে পারে, দিল্লি এখন সেই ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করার ওপর জোর দিচ্ছে।

ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় ক‚টনীতিবিদ ড. মোহন কুমার, যিনি দীর্ঘদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নেইবারহুড ফার্স্ট পলিসির একটা খুব বড় ত্রুটি হলো- অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী দেশগুলোতে আমরা রাজনৈতিক বিনিয়োগ করেছি কোনো একজন ব্যক্তির উপর, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করিনি!’ বাংলাদেশে শেখ হাসিনা, মালদ্বীপে মোহামেদ নাশিদ, আফগানিস্তানে হামিদ কারজাই, শ্রীলঙ্কায় মৈত্রীপালা সিরিসেনা বা নেপালে বাবুরাম ভট্টরাইকে নিয়ে এ ধরনের ‘ভুল’ ভারত আগেও বারবার করেছে, দিল্লিতে অনেক পর্যবেক্ষকই সে কথা বিশ্বাস করেন।

“হাসিনা সঙ্কট থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি এখন থেকে বন্ধু দেশগুলোতে কোনো ব্যক্তিবিশেষের বদলে ‘স্ট্রাকচারাল’ বা কাঠামোগত ফ্যাক্টরে লগ্নি করি, সেটি অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে বলে আমার বিশ্বাস। কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়” বলছেন ড. কুমার। শেখ হাসিনা-সংক্রান্ত ‘বিপর্যয়’ থেকেও ভারতের আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস শেখার আছে বলে ড. মোহন কুমার মনে করেন।

কয়েক দিন আগে গত সপ্তাহে দিল্লিতে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে গেছে, কিন্তু ঢাকায় যখন যে সরকার ক্ষমতায়, দিল্লি তার সাথেই সম্পর্ক রেখে চলবে ‘এটিই স্বাভাবিক’! সেই সাথে তিনি বলেন, “আমাদের এটিও মেনে নিতে হবে যে, রাজনৈতিক পরিবর্তন হবেই এবং এ ধরনের পরিবর্তন কখনো কখনো ‘ডিসরাপ্টিভ’ হবে। সে রকম ক্ষেত্রে আমাদের স্পষ্টতই দেখতে হবে কোথায় আমাদের পারস্পরিক স্বার্থের মিল হচ্ছে।”

তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো এই বিশ্বাস সুদৃঢ় করতে হবে যে, সমতাভিত্তিক সম্পর্কই হচ্ছে সবার জন্য টেকসই যা উভয়কেই উপকৃত করে।
লেখক : সমাজ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement