২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসে ইসির দায়

- প্রতীকী ছবি

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে নতুন করে গণতন্ত্রের সূচনা হয়। ১৯৯১ সালে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে দেশে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন সবচেয়ে সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়। বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পন্ন হয়। দলমত নির্বিশেষে দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে কাক্সিক্ষত ও পছন্দনীয় সরকার গঠন করেন। এ তিনটি নির্বাচনের কারিগর ছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ নির্বাচনগুলো ছিল স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, দেশে-বিদেশে প্রশংসিত।

বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু হয় মূলত সেনাসমর্থিত মইনউদ্দিন ও ফখরুদ্দীন সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় আওয়ামী লীগকে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসানোর মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও চিরস্থায়ী করতে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কাঁধে বন্দুক রেখে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কবর রচনা করে। খায়রুল হকের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে একটি রায় দেন। রায় ঘোষণার মাস দেড়েক পর ৩০ জুন জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। এর পর শুরু হয় একতরফা নির্বাচন, ভোটারবিহীন নির্বাচন, একক নির্বাচন, একদলীয় নির্বাচন, বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন, গৃহপালিত বিরোধী দলের নির্বাচন, রাতের নির্বাচন ও ডামি নির্বাচনের তামাশা।

দেশের সিনিয়র সিটিজেন এবং বিশিষ্টজনরা তত্ত¡াবধায়ক সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত দিলেও তারা সবাই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী ও সুসংহত করার পক্ষে মত দেন। নির্বাচন কমিশনকে সরকারের কবল থেকে বের হয়ে জনগণের আস্থা, চাওয়া-পাওয়ার দিকে লক্ষ রেখে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দেন। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। নির্বাচন কমিশন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি বা দাঁড়াতে চায়নি অথবা দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। সে রকম ইচ্ছাও ছিল না।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ অনুসারে, দেশে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। কমিশনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় নির্বাচন পরিচালনা, নির্বাচনে ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, আইন কর্তৃক নির্ধারিত অন্যান্য নির্বাচন পরিচালনা (এর মধ্যে সব স্থানীয় সরকার পরিষদ যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ অন্তর্ভুক্ত) করা এবং আনুষঙ্গিক কার্যাদির সুষ্ঠু সম্পাদন। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকবে, থাকবে সরকারের প্রভাবমুক্ত এবং স্বচ্ছ ও জবাদিহিমূলক নির্বাচন করতে সক্ষম। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন কি আদৌ সরকারের প্রভাবমুক্ত ছিল বিগত ১৫টি বছরে?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির পর ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনটি নির্বাচন কমিশন, যেমন- কাজী রকিব উদ্দিন আহমদ কমিশন, কে এম নূরুল হুদা কমিশন ও কাজী হাবিবুল আউয়াল দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও তারা সবাই একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন করতে পারেননি। তারা পারেননি সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে। তারা তাদের শপথ ও কোড অব কন্ডাক্ট ভুলে গিয়ে আওয়ামী লীগকে চিরকাল ক্ষমতায় রাখতে নির্বাচন নামক নাটক মঞ্চায়ন করেছিলেন, আয়োজন করেছিলেন প্রহসনের নির্বাচন, নির্বাচন নামক খেলা।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের প্রতি মানুষের ছিল অনীহা আর বীতশ্রদ্ধা। এই কমিশন মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারেনি যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবে, স্বাধীনভাবে ভোটের ব্যবস্থা করতে পারবে। কমিশন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কথামতো নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। ফলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। কমিশনের হঠকারিতায়, মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত হন, অনেকের বয়স ৩৫ হলেও এখনো পর্যন্ত তারা ভোট দিতে পারেননি। জাতীয় নির্বাচনে মাত্র ৫-৭ শতাংশ ভোট পড়ার রেকর্ড হয়, যদিও কমিশন তা মানতে নারাজ ছিল। নির্বাচন কমিশন ৩৩ শতাংশ ভোট পড়েছে অসত্য তথ্য প্রকাশ করে। এমনকি নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে মানুষের পরিবর্তে কুকুরের উপস্থিতিও লক্ষ করা গেছে। ভোটে ভয়াবহ কারচুপি, একজন পুরো এক ব্যালট বই সিল মেরেছেন। আনসার, পুলিশ ও প্রিজাইডিং অফিসারের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যে যার মতো করে নৌকা মার্কায় ভোট দেন। এককথায় বলতে গেলে, বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রথা, সিস্টেম ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। জাতি ঘৃণাভরে দেখেছে একতরফা নির্বাচন, তামাশার নির্বাচন যেখানে বিনাভোটে ১৫৪ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছিল, অর্থাৎ নির্বাচন না করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযোগ পায়।

সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। প্রয়োজনে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কমিশন নিজেদের দায়িত্বকে আমানত হিসেবে গ্রহণ করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পথ সুগম করবে, এটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশনের কাছে। কিন্তু রকিব উদ্দিন কমিশন, হুদা কমিশন ও আউয়াল কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। যারা বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন, রাতের নির্বাচন ও ডামি এবং প্রহসনের নির্বাচন উপহার দিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন, নির্বাচনকে হাসির বিষয় বানানোর দায়ভার তারা এড়াতে পারবেন না। নির্বাচন কমিশন সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। কমিশনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের প্রচলিত আইনে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার।

যেকোনো দেশে গণতন্ত্র সুসংহত করতে স্বাধীন, সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই। ফ্রি, ফেয়ার ও ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও মেরুদণ্ডওয়ালা নির্বাচন কমিশন খুব প্রয়োজন। আমরা কথায় কথায় শুধু পাকিস্তানের বিরোধিতা করি, অথচ সে দেশের নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত স্বাধীনভাবে নির্বাচন করতে সক্ষম। দেশটির নির্বাচন কমিশনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রভাব চলে না, বিভিন্ন সময়ে আমরা তার উদাহরণ দেখেছি। ছোট নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো দেশেও নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে জাতীয় নির্বাচন করতে সক্ষম। আর ভারতের নির্বাচন কমিশন তো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাকে যেন ধর্মীয় অনুশাসন মনে করে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন হলেও এখনো যেমন পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হতে পারেনি, ঠিক তেমনি দেশের সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন- নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসনও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম। নির্বাচন কমিশন যতদিন পর্যন্ত কোনো একটি দলের বা ক্ষমতাসীন দলের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করবে বা নির্বাচন পরিচালনা করবে, ততদিন পর্যন্ত দেশের মানুষ সত্যিকারের গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন না। তাই, দরকার নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। আমরা আশাবাদী, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের কাজটি দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সম্পাদন করবে।

লেখক : সলিসিটর, সিনিয়র কোর্ট অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস, লন্ডন


আরো সংবাদ



premium cement
বড় প্রকল্পে বরাদ্দের টাকা যেন শতভাগ সদ্ব্যবহার করা হয় : সাখাওয়াত হোসেন জুলাই বিপ্লবে যারা শহীদ ও আহত তাদেরকে রাষ্ট্রীয় উপাধি দিতে হবে : বুলবুল ছাত্র আন্দোলনের সর্বশেষ শহীদের পরিবারকে জামায়াতের অর্থ সহায়তা এবারের জাতিসঙ্ঘ সম্মেলন যেসব কারণে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গোয়ালন্দে চরমপন্থী দলের সদস্যকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররা আ’লীগের বড় দোসর : রিজভী বিটিভির নতুন মহাপরিচালক মাহবুবুল আলম জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে সংস্কার ও বন্যা পুনর্বাসন ব্যবস্থায় সহযোগিতা দেবে দ্রুত দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি নবনিযুক্ত রামেবি ভিসির গুমের অভিযোগ দাখিল করতে হবে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে দিসানায়েককে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা

সকল