২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিকে ‘না’ বলুন

- প্রতীকী ছবি

এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ ঘোষণা। অনেকেই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। দেশে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সাফল্য ও স্বৈরসরকারের পতনের পর এই দাবি বাস্তবায়নের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম প্রধান সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি এর পক্ষে তাদের দাবি জোরালো করতে সারা দেশে তাদের সব কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্রের হাতে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে সবধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন পাদে ছাত্র আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান অন্যতম। সর্বসাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেশের ওপর দীর্ঘ দেড় দশক ধরে চেপে বসা স্বৈরশাসকের তখতে তাউসকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে এমন এক নজির স্থাপন করেছে, যা এ দেশ তো বটেই, বিশ্ব ইতিহাসেই এক বিরল ঘটনা। অনেকেই এটাকে এখনো এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নরূপে বিবেচনা করে থাকবেন।

এতকিছুর পরও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মোটা দাগে ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনে আধিপত্য বিস্তারকারী প্রধান ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি, নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে দেখা গেছে, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। তাদের তেমন কোনো গঠনমূলক কার্যক্রম নেই। সরকারি দল ও সরকার মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করাই তাদের মূল কাজ। বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করে তারা নিয়মিতভাবে নির্বিবাদে হলে হলে সিট বাণিজ্য, ডাইনিং-ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, ক্যাম্পাস ও আশপাশের দোকানপাট থেকে বখরা আদায়, ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের মতো নানা দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যায় বছরের পর বছর। সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের কাছে ক্ষমতার দাপট দেখানো ও তাদের শারীরিক-মানসিকভাবে হেনস্তা করা সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দেখা যাবে, এগুলোর বেশির ভাগের সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন কিংবা কোথাও কোথাও ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তারকারী অন্য কোনো প্রধান ছাত্রসংগঠন জড়িত। এভাবে ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে হয়ে উঠেছে বিভীষিকার মতো এক দুঃস্বপ্নের নাম। আর এ কারণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবি আজ এক গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।

অন্য দিকে এ দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে ছাত্ররাজনীতি যে গৌরবোজ্জ্বল ভ‚মিকা রেখেছে তা স্মরণ করে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখা প্রয়োজন আছে বলেও অভিমত দিয়ে যাচ্ছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটি সমাজে ছাত্ররাই হয়ে থাকে সবচেয়ে প্রতিবাদী অংশ। তারা যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যেভাবে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারে সেটি সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। তা ছাড়া ছাত্রদের মধ্যে সবসময় দেশ ও সমাজের জন্য কিছু করার আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। তারুণ্যের এই শক্তিকে ঠিকমতো কাজে লাগানো গেলে সমাজে অনেক কল্যাণধর্মী কাজ সম্পাদন সহজ ও সম্ভবপর হয়। বলাই বাহুল্য, তাদেরকে এভাবে কাজে লাগাতে হলে সঙ্ঘবদ্ধ প্রচেষ্টার বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে তাদের দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে এ ধরনের কল্যাণধর্মী ও গঠনমূলক কাজে অংশগ্রহণের পথও বন্ধ করে দিচ্ছেন না তো? আরো প্রশ্ন আছে। শিক্ষাঙ্গনে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাড়াও আরো অনেক ছাত্রসংগঠন কাজ করে থাকে। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের অপতৎপরতা ও অপরাধমূলক কাজকর্মের দায়দায়িত্ব তারা নেবে কেন? দেখা যাবে, সরকারি দল কোনো ছাত্রসংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে অনেক সমস্যা এমনিতেই নেই হয়ে যাবে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে নতুন যে সমস্যা দেখা দিতে পারে তা হলো, সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের অনুপস্থিতিতে অন্যান্য ছাত্রসংগঠন বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর একতরফা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তা ছাড়া আপনি এককভাবে একটি মাত্র ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা বন্ধের কথা বলতে পারেন না। কাজেই, হয় আপনাকে সব ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা বন্ধ করে দিতে হবে, নতুবা এমন একটি বন্দোবস্তে যেতে হবে যেন ছাত্রসংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে কাজ না করে এবং তাদের কাছ থেকে বিশেষ ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা না পায়।

এবারে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে শিক্ষকরাজনীতির প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের জানা মতে, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বেসরকারি কলেজশিক্ষকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আইনি কোনো বাধা নেই। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যা করছেন তা হলো, বিভিন্ন সেক্টরে রাজনৈতিক দলগুলোর যে পেশাভিত্তিক শাখা রয়েছে সে রকম এক একটি শাখা হিসেবে ভূমিকা রাখা। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশের রাজনীতিতে থিংকট্যাংক হিসেবে ভ‚মিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের এখানে রাজনীতিতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের অনেকেই মূলত দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। তাদের কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য থাকে রাজনৈতিক যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন পদ-পদবি বাগানো। অন্য যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা হলো, শিক্ষাঙ্গনে সমমনা শিক্ষক ও ছাত্রসংগঠনের মধ্যে একধরনের নেক্সাস গড়ে ওঠে। এরা একে অপরকে বিভিন্ন ইস্যুতে সাপোর্ট দেয়। কোনো সংগঠন, বিশেষ করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা, যখন নানাবিধ অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে তখন সরকার সমর্থক শিক্ষকদের অনেকেই তাদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অনেকটা অন্ধ সমর্থন দিয়ে যান। তা ছাড়া এদের একটি অন্যতম কাজ হয়ে থাকে কিছু পদ-পদবি বা সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সব কাজে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাওয়া। সবমিলিয়ে দেখা যাবে, শিক্ষকরাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তেমন কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে না। এসব কারণে ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকরাজনীতি বন্ধেও জোরালো দাবি উঠেছে।

বিশ্বের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, যেসব দেশ ও জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে তারাই বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মূল প্রাঙ্গণ। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি ও বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। বিদ্যার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিজেদের যথোপযুক্ত রূপে গড়ে তুলতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা রাজনীতি করবেন কি না কিংবা কতটুকু, কী আঙ্গিকে করবেন সেটি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যাচর্চার অঙ্গনের পরিবর্তে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে পরিণত হবে- সেটি কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement