২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রশ্ন ফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্য কোটার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর

- প্রতীকী ছবি

২০২৪ সালে আমরা যে বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছি সেটির সূচনা হয়েছিল চাকরিতে বিভিন্ন কোটার সংস্কারের জন্য পরবর্তীতে সেটিই বিশাল এক আন্দোলনে মোড় নিয়ে আজকের এই বাংলাদেশ। কিন্তু যেখানে একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য প্রশ্ন ফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্য কোটার চেয়েও শতগুণ বেশি ভয়ঙ্কর সেখানে এখনো আমরা নিশ্চুপ। আর সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা, মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষাসহ চাকরির পরীক্ষা প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিসিএস, ব্যাংক, নন-ক্যাডারসহ প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নই ফাঁস হচ্ছে, নিয়োগবাণিজ্য চলছে যারা প্রশ্ন ফাঁস করছেন, নিয়োগবাণিজ্যের সাথে যুক্ত থাকছেন তাদের মধ্যে যারা ধরা পড়ছেন, স্বীকার করছেন, জেলে যাচ্ছেন অথচ দিন শেষে এসব পরীক্ষার সাথে যুক্ত থাকা কর্তৃপক্ষ অবলীলায় বলছেন প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ঘটনায় ঘটে নি। আর আমাদের রাষ্ট্রের মূল দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছেন।

ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নিয়োগসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে ২০০ মামলা হয়। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন ছাত্রসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। দেশে ৬০ হাজার শিক্ষকের সনদ জাল এমনই এক শিরোনামে সমকাল থেকে খবর প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর। দৈনিক ইত্তেফাকে ১১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় ২০২৪ সালে ৩১ মার্চ বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে ৯৯ হাজার শিক্ষকের যে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় তাতে ২০ থেকে ২২ হাজার শিক্ষক সুপারিশ পান বাকি ৭৭-৭৮ হাজার শিক্ষক সুপারিশ পেয়েছেন জাল সনদে অর্থের বিনিময়ে।

২০২৪ সালের ৭ জুলাই চ্যানেল ২৪-এর তদন্তে উঠে আসে বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের পুরো বিষয়টি যা ২০০৫ সাল থেকেই একটি চক্র করে আসছে এবং সেখানে রিসেন্ট বিসিএসের প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণও তারা দেখান। এরপরও ১১ সেপ্টেম্বর পিএসসি সভাপতি অবলীলায় জানালেন, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগটি প্রমাণ হয়নি। কর্তৃপক্ষের অবলীলায় প্রশ্নফাঁসের অস্বীকার করার ঘটনা এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে গেছ। বিসিএসের মতো পরীক্ষার প্রশ্ন যেখানে ফাঁস হচ্ছে সেখানে আস্থার আর জায়গা কোথায়?

আচ্ছা এই যে এত এত প্রশ্ন ফাঁস এবং নিয়োগবাণিজ্য ঘটছে এর দায়ভার কার? দায়ভার কার- এর উত্তরের আগে এবার একটু ২০০৫ সালের আগে ফিরে দেখা যাক- সাল ২০০৩,২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা, ইতিহাসে প্রথমবার এই বিসিএস পরীক্ষাতেই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। দৈনিক ইনকিলাব, প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হয় কিন্তু পিএসসি চেয়ারম্যান প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেন। এমনকি প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পরও ৭২ ঘণ্টায় পিএসসি চেয়ারম্যান কোনো পদক্ষেপ নেননি। অবশেষে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গোয়েন্দা বাহিনী সত্যতা যাচাই করার পরে পরীক্ষাটি বাতিল করা হয়। ৮ আগস্ট আবারো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

সেই সময়ে আমি ছিলাম এনএসআইতে। পরীক্ষার আগের রাতে নীলক্ষেতসহ বিভন্ন জায়গা থেকে এনএসআই টিম পরীক্ষা শুরুর কয়েকজনকে প্রশ্নপত্রসহ হাতেনাতে ধরার পর রমনা থানায় আটকে রাখা হয়। পরীক্ষা শুরুর পর প্রায় ৮০ শতাংশ প্রশ্নের মিল পাওয়া যায়। শিরোনামে খবরটি প্রকাশিত হয়, এ ছাড়া প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসে। ব্যক্তিগতভাবে পিএসসি চেয়ারম্যানকে পরীক্ষা বাতিলের অনুরোধ করা হলে তিনি প্রথমে অগ্রাহ্য করেন। পত্রিকা সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এবং সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষা বাতিলের জন্য আমার চ্যানেলে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হলে তা আবার গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।

পরে কিভাবে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে তা বিভিন্ন দেশের নিয়মাবলির প্রেক্ষাপটে একটি সুপারিশ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমার সংস্থা থেকে প্রেরণ করা হলেও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এটি গেল প্রশ্নফাঁসে আমার অভিযানের কথা।

এবার একটু নিয়োগবাণিজ্য ও বদলিবাণিজ্যে আসি। পরবর্তীতে ২০০৪ সালে আইনশৃঙ্খলা, অনিয়ম-দুর্নীতিসংক্রান্ত বিষয়াদি ও কারণসহ নানা তথ্য যথাযথভাবে উদঘাটন করে তা আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সরকারকে অবহিত করতে থাকি। ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী সভাপতিত্বে পুলিশের নিয়োগ, বদলিসহ বেশ কিছু বিষয়ে অনিয়ম দুর্নীতির কথা সরাসরি তুলে ধরি যা ২০০৪ সালের ৩ এপ্রিল বেশ কিছু পত্রিকায় হেডলাইনে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে সব ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া তো দূরের কথা; বরং তাদের কিছু কিছু ব্যাপারে জড়িত থাকার বিষয় উন্মোচিত হতে দেখে উল্টো আমাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সেখানেও আমি আমার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করতে থাকি। প্রথম থেকেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ব্যক্তিস্বার্থকে দূরে রেখে জাতীয় স্বার্থে, দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য প্রশ্নফাঁস, নিয়োগবাণিজ্য, বদলিবাণিজ্য থামানোর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে ক্যান্সারের মতো আজ হয়তো সব জায়গায় তা ছড়িয়ে যেতে পারত না। বিচারহীনতা ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান সেক্টরে ক্ষমতালোভী অনৈতিক মানুষদের জন্যই আজকের এই পরিস্থিতি।

নিঃসন্দেহে দ্বিধাহীনভাবে কোটা মেধাবীদের জন্য একটি চরম বৈষম্য কিন্তু প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্যের ফলাফল তার চেয়েও শতগুণ ভয়াবহ। যার ফল শুধু মেধাবীরা ভোগ করছেন না; বরং পুরো রাষ্ট্র এক অসারতার দিকে চলে গেছে, চলে যাচ্ছে এখনো যদি এর লাগাম টেনে ধরা না হয় তাহলে যে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে এই নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে তা বৃথা প্রমাণিত হবে। অতি দ্রæত এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য পিএসসির অধীনে বা অন্য কোনো ভার্সিটি বা প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রশ্ন তৈরি না করে নতুন একটি কমিটি গঠন হোক যাদের দায়িত্ব হবে পুরো দেশের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা। ডিজিটাল যুগে অনেক আগে প্রশ্ন ছাপানোর প্রয়োজন নেই। পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে যে প্রশ্নে পরীক্ষা হবে সেই প্রশ্ন ছাপানো হবে এবং প্রশ্ন তৈরি থেকে শুরু করে ছাপানো পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এর সাথে যুক্ত থাকবে কোনোভাবেই যদি প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে এবং প্রশ্নসহ কেউ গ্রেফতার হয় তাহলে পুরো টিমকে এর দায়ভার নিতে হবে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে ফৌজদারি অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরীক্ষার আগে থেকেই প্রতিটি সেন্টারে গোয়েন্দা সংস্থার তদারকি থাকবে এবং গোয়েন্দা সংস্থায় উপযুক্ত লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয়করণ এবং আত্মীয়করণের সুযোগ যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে গোয়েন্দা সংস্থার প্রত্যেক কর্মকর্তা তাদের দলের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারে, জাতীয় স্বার্থকে, নিরাপত্তাকে সবার আগে মূল্যায়ন করতে পারে। কোটা না থাকলেও যদি প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগবাণিজ্য বন্ধ করা না যায় তাহলে মেধাবীদের দুর্দশা তথা পুরো রাষ্ট্রের দুর্দশা ঠেকানো সম্ভব নয়।

লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও প্রো-ভিসি, বিইউপি


আরো সংবাদ



premium cement