২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম ও রাজনীতি

-

ধর্মনিরপেক্ষতা একটি ধর্মবিমুখ বিশ্বাস ব্যবস্থা যা ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে বা এমন বিশ্বাস করে যে, ধর্ম রাষ্ট্রের বিষয়ের অংশ বা জনশিক্ষার অংশ হওয়া উচিত নয়। গির্জা ও রাষ্ট্রকে আলাদা করার নীতি হলো ধর্মনিরপেক্ষতার উদাহরণ। এটি রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শনের একটি ব্যবস্থা যা সব ধরনের ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে।

তাই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যদি ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা হয়, তবে বাস্তবে এটি বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন বা ভারতে কোথাও বিদ্যমান নেই।

অনেক পশ্চিমা গণতন্ত্রে, ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় চরিত্রের একটি ধর্মঘেঁষা রাজনীতির আবরণমাত্র। যখন ধর্মকে রাজনীতির সাথে যুক্ত করা হয়, তখন মানুষের উদ্বেগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উপাদান একত্র হয় : ধর্ম ও রাজনীতি উভয়ই ইতিহাসের জালে ধারাবাহিকভাবে একে অপরকে স্বীয় স্বার্থ সাধনে ব্যবহার করেছে। প্রকৃতপক্ষে, রাজনীতি কিভাবে একটি শক্তিশালী ধর্মীয় প্রভাবের প্রতি নিরপেক্ষ থাকতে পারে? আর ধর্মও কিভাবে মানুষের অস্তিত্বের স্থান সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, মানবসমাজ ও রাজনীতির রূপ, প্রকাশ এবং দিকনির্দেশনায় অনাগ্রহী থাকতে পারে? ধর্ম মানুষের মনস্তত্ব ও সংস্কৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। ধর্ম আমাদের মূল্যবোধ, আকাক্সক্ষা এবং জীবনদৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করে, আমাদের অভিজ্ঞতার মাহাত্ম্য অনুসন্ধান, আমাদের নৈতিকতার ভিত, পৃথিবীতে কী সঠিক এবং কী ভুল তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগ, নৈতিক মূল্যবোধ নির্মাণ, আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্তিত্বের গঠন, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন পূরণের প্রয়াসের পথে আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার অন্বেষা, আমাদের সম্প্রদায়ের অনুভূতি এবং পুরুষ ও নারীর সম্পর্ক এবং অবশেষে সৃষ্টির প্রতি বিস্ময়ের অনুভূতি নির্দেশ করে। সমস্ত মানুষ এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয় এবং নিজেদের জন্য উত্তর খুঁজতে বাধ্য হয়। এই শ্রেণীর মধ্যে তারাও আছে যারা নিজেদেরকে ধার্মিক মনে করে না।

আমেরিকানদের, বিশেষ করে রাজনীতির সাথে ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে একটি বিহ্বলতা বা দ্বিধা রয়েছে। আমেরিকান ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য, অদ্ভুতভাবে, জীবনে ধর্মের ভূমিকার প্রতি আমেরিকান উদাসীনতার কারণে হয়েছে তা নয়; বরং এটি আবেগের সাথে ধর্মের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধদের উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। ধর্মের প্রতি এবং এর বৈচিত্র্যময় রূপের সংরক্ষণ যা এর অনুগামীদের আমেরিকা মহাদেশে প্রথম দিকে নিয়ে আসে; তাদের লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিশ্বাস এবং তার অভিব্যক্তিকে রাষ্ট্রের ক্ষমতা থেকে রক্ষা করা, যেটি তাদের পেছনে ফেলে আসা দেশে (ইংল্যান্ড) নিপীড়িত হয়েছিল।
আমেরিকা আজ শিল্পোন্নত বিশ্বের সবচেয়ে ধর্মমনা দেশ হিসেবে এখনো বিস্তৃতভাবে ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে যতটা সম্ভব আলাদা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেটি উভয়েরই সুরক্ষার জন্য। তবুও আমেরিকান রাজনীতির সবচেয়ে আবেগপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো ঠিক সেগুলো যা ধর্মীয় উদ্বেগকে অন্তর্ভুক্ত করে, এমনকি যদিও সেগুলো স্পষ্টভাবে ধর্মীয় ভাষায় প্রকাশ করা হয় না।

ভারতে প্রতিটি পদক্ষেপে হিন্দু ধর্মের একটি স্পর্শ অনুভূত হবেই। সম্রাট অশোক ভারতীয় জাতীয় গর্বের প্রতীক। সম্রাট অশোক হলেন ভারতীয় অনুপ্রেরণা এবং শক্তির অপরিহার্যতার উৎস। স্বাধীনতার সময় ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি নতুন ডিজাইন করা জাতীয় পতাকার চরকাটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর হিন্দু সম্রাট অশোকের ‘চক্র’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছিল। সম্রাট অশোক মূলত কৌলিঙ্গ যুদ্ধের পরেই বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ‘চক্র’ স্তম্ভের ওপরে দু’টি সিংহ দ্বারা সংলগ্ন ছিল, এটিও একটি জাতীয় প্রতীক। পতাকার গেরুয়া রংটিও হিন্দু ধর্মের প্রতীক। যেহেতু ভারতীয় জনসংখ্যার বেশির ভাগই হিন্দু, তাই হিন্দু ধর্মে ভারতীয় অহঙ্কার প্রকাশে কোনো দোষ আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং এটি অবশ্যম্ভাবী যে, হিন্দুজাত আত্মিক বৈশিষ্ট্য (Hindu ethos) ভারতীয় সমাজে প্রতিফলিত হবেই।

বিশ্বের সব প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ধর্মীয় বিষয়টিকে সমুন্নত করা হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত বিশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবাক্য (Motto) ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে বা ধর্মীয় শাস্ত্রের বাণীর ওউপর ভিত্তি করে সৃষ্টি করা এবং এর বিষয়বস্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক হলেও তারা এটিকে উপেক্ষাই করে বলে মনে হয়। নিম্নলিখিত উদাহরণ উল্লেখযোগ্য- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবাক্য : ‘Dominus illuminatio mea’, হিব্রু বাইবেল থেকে একটি শ্লোক বেছে নেয়া হয়েছে যার অর্থ ‘প্রভু আমার আলো’। শব্দগুলো হলো সাম-২৭ (Psalm) এর শুরুর শব্দ। শুধু অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তার নীতিবাক্যের জন্য সামের বাণী ব্যবহার করেছে এমন নয়। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরি, সেই সাথে নর্থ ক্যারোলিনার ‘নীতিবাক্য’ সাম (Psalm) থেকে নেয়া (১২১ : ২) Shuile Togum Suas যার অর্থ ‘আমি আমার চক্ষু প্রসারিত করব’। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ‘In lumine tue videbirnus lumen’ ব্যবহার করে, যার অর্থ- ‘তোমার আলোতে আমরা আলো দেখি’ (সাম ৩৬ : ৯)।

ইউনিভার্সিটি অব অ্যাবারডিনের মটো হলো- ‘Initium sapientine timor domini’ যার অর্থ ‘সৃষ্টিকর্তার ভয়ই জ্ঞান-প্রজ্ঞার শুরু’ (সাম ৩ : ১০)। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির মটো- ‘in deo speramus’ যার অর্থ- ‘ঈশ্বরে আমরা ভরসা করি’ (সাম ২৭ : ১৪)। ঘটনাগতভাবে এটি থেকেই আমেরিকান মুদ্রায় ‘ঈশ্বরে আমরা বিশ্বাস করি’র উৎপত্তি বলেও মনে হয়। এ ছাড়াও দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা ইহুদি ধর্মগ্রন্থ ‘পেন্টাটিউক’র বাক্য ব্যবহার করে। ‘ওয়াশিংটন’ বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাটিন ভাষায় ‘Fiat Lux’ ব্যবহার করে, যার অর্থ- ‘আলোকিত হোক’ (জেনেসিস ১ : ৩)। ইউনিভার্সিটি অব ক্যানসাস ব্যবহার করে- ‘Videbo Visioner hanc magnum guar non comburatur nibus’ যার অর্থ- ‘আমি এই দুর্দান্ত দৃশ্যটি দেখব, কিভাবে জ্বলন্ত ঝোপ দেখা যায় না’ (এক্সোডাস ৩ : ৩)। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও এই নীতিবাক্যটি (Motto) ব্যবহার করে। উত্তর ক্যারোলাইনার ডিউক ইউনিভার্সিটি মেথডিস্ট চার্চের সাথে একটি সহায়ক সম্পর্ক বজায় রাখে। আর এই ইউনিভার্সিটির নীতিবাক্য হলো- ‘Erudito et Religio’ যার অর্থ- ‘পাণ্ডিত্য এবং ধর্ম’- এটা বোঝানো হয়েছে। ইয়েল ইউনিভার্সিটি হিব্রু শব্দ ‘Lux et Veritas’ ব্যবহার করে। আর ইহুদি ধর্মের সাথে হিব্রু ভাষার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির মটো হলো- ‘Dei sub Numine Viget’ যার অর্থ- ‘ঈশ্বরের সুরক্ষায় সে বিকশিত হয়।’
আরো অনেক পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ রয়েছে যাদের মটো বা নীতিবাক্য জুডিও-খ্রিষ্টান ধর্মীয় বই থেকে নেয়া হয়েছে। অবশেষে দেখা যাক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগোটি কেমন- লোগোটিতে একটি হাতি, পদ্ম ফুল, খোলা বই চিত্রিত করা হয়েছে। হাতিটি হিন্দু দেবতার ‘গণেশ’ প্রতীক, যা বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞা নির্দেশ করে। হিন্দু ধর্মের গণপত্য (Ganapatya) ঐতিহ্যে গণেশ হলেন পরম দেবতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র, গ্রেট ব্রিটেন ও ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবাক্য এবং লোগো যদি তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের প্রতিষ্ঠিত নীতিবাক্যটি (Motto) ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ যেটি কুরআনে উল্লিখিত, যার অর্থ- ‘হে প্রভু আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করুন’ সরিয়ে ফেলার কি যুক্তি থাকতে পারে? কেউ কি বাংলাদেশের একাডেমিয়া এবং ‘টকশো’ পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ কিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবাক্য হিসেবে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির বিরুদ্ধাচরণ হয়? যেখানে সেকুলার পশ্চিমের রাষ্ট্রনেতারা তাদের ধর্মগ্রন্থের বাক্য অনায়াসে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবহার করতে পারে?

বিশ্বের সব বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যদি ধর্মনিরপেক্ষতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে নিজ নিজ ধর্মকে সমুন্নত রাখতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন পারবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কুরআনের আয়াতটি তার Motto হিসেবে পুনরায় সংযোজন করতে?


আরো সংবাদ



premium cement
রাজধানীতে সংঘর্ষে ২ যুবক নিহত জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস কুড়িগ্রামের উলিপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু তোফাজ্জল হত্যা : ঢাবির ৬ শিক্ষার্থীর দায় স্বীকার কুমিল্লা-১০ বিনির্মাণে আমাদেরকে কাজ করতে হবে : ইয়াছিন আরাফাত উন্নয়নের নামে দুর্নীতির মহোৎসবে মেতেছিল আ’লীগ : হামিদ আজাদ ভাইকে হত্যা করাতে ১৪ মাসের ষড়যন্ত্র ভান্ডালজুড়ি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে ঢাবি ও জাবিতে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে খুলনায় শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাংবাদিক রনো ও তার পরিবার চট্টগ্রাম পানগাঁও নৌরুট জনপ্রিয় করার উদ্যোগ

সকল