২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

সরকারের জন্য সতর্কবার্তা

- ফাইল ছবি

গত ৮ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ডক্টর ইউনূস শান্তিমতো একটি কাজও করতে পারছেন না। প্রথম কয়েকটি দিন তো গেল সব কিছু বুঝে উঠতেই। তারপর তিনি পেলেন একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কিছু দক্ষ-অদক্ষ, কিছু উচ্চাভিলাষী ও দু-একজন চিহ্নিত ষড়যন্ত্রকারীকে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে পেলেন, যাদের সাহায্যে আগামী বেশ কিছু দিন তাকে পরিচালনা করতে হবে অসম্ভব অসহিষ্ণু একটি জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি দেশ। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পেলেন ভারতের মতো একটি বিশাল প্রতিবেশী দেশের বিরূপতা। গত দেড় মাসে যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েননি, সেটি তার এবং আমাদের মতো নাগরিকদের জন্য বিশাল এক পাওয়া।

বাংলাদেশের মানুষ কিছু ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু। প্রত্যাশিত কিছু না পেলে নিজের ক্ষতি করতেও তারা পিছপা হয় না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর তারা ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারের পদলেহী দালালদের বাড়িঘর এবং কিছু মিলকারখানা ধ্বংস করে। কিন্তু তার অনেক পরে সাভারে অবস্থিত গাজী টায়ার কারখানায় আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে। পরিতাপের বিষয় হলো- এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ওই গাজী গ্রুপেরই কর্মচারীদের একটি অংশ। গাজী টায়ারস দেশের হালকা কমার্শিয়াল যানবাহনের প্রায় ৫০ শতাংশ চাকার প্রয়োজন মেটাত। লাভ কার হলো? দস্তগীর গাজী বর্তমানে জেলে আছেন। তিনি তার দালালি ও অন্যান্য গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তি পাবেন, এটি আমার প্রত্যাশা।

স্বৈরাচারী সরকারের দালালরা বিভিন্নভাবে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করেছে। এর মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষই দেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগ করেছে। গোলাম দস্তগীর গাজী তাদের একজন। আরেকটি উদাহরণ দেয়া যায়, সেটি হলো- প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের একটি কারখানায় আগুন দেয়া। যদিও উপস্থিত জনতা-কর্মচারীরা ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় দ্রুত এই আগুনকে নিভিয়ে ফেলে; তা না হলে কী পরিমাণ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো, তা কী আমরা চিন্তা করে দেখেছি? সালমান এফ রহমান পতিত স্বৈরাচারের অন্যতম দোসর। এই লোকটির কারণে দেশের পুঁজিবাজারে দেশের লাখ লাখ মানুষ তাদের শেষ সম্বল হারিয়েছেন। বহু ব্যাংক তার ছোবলে ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বর্তমানে জেলে। তাকে দ্রুত বিচার করে উপযুক্ত সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে, এটি আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু তার কারখানায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে আমাদের কী লাভ হচ্ছে? প্রয়োজন হলে সরকার ‘প্রেসিডেনশিয়াল অর্ডার’-এর মাধ্যমে তার বা তার মতো মানুষদের কারখানাগুলো জাতীয়করণ করে হলেও রক্ষা করা এবং প্রয়োজনে ‘প্রশাসক’ নিয়োগ করে পরিচালনা করা যেতে পারে। কিন্তু দেশের সম্পদ পুড়িয়ে দেয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর এই প্রবণতা কিন্তু এখনো থামেনি।

গত এক মাস ধরেই আশুলিয়া ও সাভারে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প এলাকায় অরাজকতা চলছে। এখানে বেশ কিছু কারখানায় খুচরা ভাঙচুরও চালানো হয়েছে। সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ বহু কষ্টে এখনো এখানে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেয়নি। কিন্তু, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যেভাবে উসকানি দিয়ে চলেছে, তাতে তারা আর কতদিন এলাকাটিকে শান্ত-নিরাপদ রাখতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এখানে যারা উসকানি দিচ্ছে, তাদের ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবেই পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে নর্দার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক হৃদয়কে গার্মেন্ট শ্রমিকদের উসকানি দেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও অন্যান্য উসকানিদাতা ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও শাস্তি দেয়া এখন অতীব জরুরি। এই এলাকার পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশের মালিকই পতিত স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী হওয়ার কারণে বর্তমানে পলাতক। ফলে শ্রমিকদের সাথে সরাসরি আলাপ আলোচনায়ও তারা সক্ষম হচ্ছেন না। এই শ্রমিকদের দাবিগুলো কিন্তু তেমন বড় কিছু না। সমঝোতার একটি ভালো উদ্যোগ নিলে শ্রমিকদের অসন্তোষ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন উসকানির জন্য সেই উদ্যোগটা নেয়া হচ্ছে না বা সফল হচ্ছে না। আমাদের একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের গার্মেন্ট শিল্প আমাদের রফতানি বাণিজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত এবং এই শিল্পে সঙ্কট সৃষ্টি হলে তার সুফলটা কিন্তু চলে যাবে প্রতিবেশী দেশের ঝুলিতে।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর দেখা গেল শাহবাগ চত্বরে দেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর কিছু তরুণ সদস্য অমূলক আট দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য অবরোধ সৃষ্টি করেছে। এদের স্লোগান পরিষ্কারভাবেই গত জুলাই-বিপ্লবের মূল চেতনার পরিপন্থী। তারা হুমকি দিয়ে বলেছে- অবিলম্বে তাদের দাবি না মানলে তারা এক দফার আন্দোলন, অর্থাৎ সরকার পতনের আন্দোলনে চলে যাবে! তাদের বক্তব্য ধৃষ্টতাপূর্ণ। এটি বলা নি®প্রয়োজন যে, এই ছেলেগুলো গত আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিল না। তারা মূলত ছাত্রলীগের সমর্থক। বর্তমানে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী গণতান্ত্রিক পরিবেশে এসে তারা এই বিপ্লবের অর্জনগুলোকেই ধ্বংস করতে চাচ্ছে। তাদের পেছনে কে বা কারা আছে, তা সহজেই অনুমেয়। এখন সরকারের কাজ হলো এই দুষ্কৃতকারীদের অবিলম্বে ধরে ফেলে এদের এই প্রতিবিপ্লবী তৎপরতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেয়া।

গত ১৫ বছরের দলীয়করণের কারণে পুলিশ বাহিনীর একটি বড় অংশ এখনো আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত। তাদের ‘ডিএনএ’তে রয়েছে ছাত্রলীগ। সে কারণে তারা তাদের কর্তব্যকাজে মন দিচ্ছে না বা দেয়ার সাহস পাচ্ছে না। আমি মাসখানেক আগেই পরামর্শ দিয়েছিলাম, আন্দোলনকারী ছাত্র-যুবকদের মধ্যে থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও শারীরিক সক্ষমতা সাপেক্ষে পুলিশের এএসআই থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর পদে নতুন নিয়োগ দেয়ার জন্য। সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলে এত দিনে আমরা তার সুফল পেতে শুরু করতাম। কিন্তু, সরকার এদিকে এখনো নজর দেয়নি। আমি আশা করব, সরকার অতি দ্রুত এই সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জে যাওয়ার পথে বিএনপিকর্মীদের গাড়িবহরে আক্রমণ করে দু’জনকে হত্যা এবং বেশ ক’জন মানুষকে আহত করেছে আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকরা। তারা ঢাকা মহানগরীতেও মাথাচাড়া দেয়ার চেষ্টা শুরু করছে।

উপরের ঘটনাগুলোকে কী বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়? অন্তত আমি তেমনটি মনে করি না। আমার ধারণা, এটি একটি দেশবিরোধী পরিকল্পনার অংশ, যার লক্ষ্য হলো এই দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করে রাখা, যাতে স্বৈরাচারের ফিরে আসার পথ, সুযোগ হয়। ইউনূসের সরকারের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা অটুট। আমরা সবাই চাই তিনি যে কঠিন সময়ে, কঠিন কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন তাতে তিনি সফল হবেন। আমরা দেশের জনগণ এ জন্য অনেক ত্যাগ শিকার করতেও প্রস্তুত আছি। কিন্তু তাকে ও তার উপদেষ্টাদের সতর্কভাবে বিদ্যমান পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে ও দেশের নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কাজগুলো অবিলম্বে শুরু করতে হবে। তা না হলে এ দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আবারো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

লেখক : সাবেক সরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement