সুশীলতার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের মূল্যবোধ
- ওহিদুল ইসলাম
- ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:২৯
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি সফল বিপ্লব হয়ে গেল। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় পরও বিপ্লবের মূল্যবোধ রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। সুশীলতার চাপে আড়াল হয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের মূল্যবোধ। যে আকাঙ্ক্ষা ও মূল্যবোধকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদবিরোধী একটি গণজাগরণ তৈরি হয়েছিল সেটা কি ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে? ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য যে বন্ধন আমাদের সবার মাঝে ছিল সেটাও কি শিথিল হয়ে যাচ্ছে? এসব প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে।
১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন হয় তখন ভ্লাদিমির লেনিন, স্টালিনের সকল মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। লেনিনগ্রাদ সিটির নাম পূর্বের ’সেন্ট পিটার্সবার্গ’ নামে ফিরিয়ে নেয়া হয়। স্টালিনের নামে প্রতিষ্ঠিত স্টালিনগ্রাদ হয়ে যায় ভোলগোগ্রাড। এটা যেকোনো সফল রিভ্যুলেশনের বৈশিষ্ট্য।
দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময়ের প্রচেষ্টায় ফরাসি বিপ্লব সফল হওয়ার পর পুরো রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে যায়। সামন্তপ্রথার বিলোপ ঘটে, পুরনো বিচার ব্যবস্থার অবসান ঘটে, ক্যাথলিক চার্চগুলো নিজেদের গোঁড়ামি ত্যাগ করে পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসি বিপ্লব ছিল সাড়ে ১০ বছরের সংগ্রামের ফসল যেখানে আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সাড়ে ১৭ বছর (এক এগোরোর সরকারসহ) সংগ্রাম করেছি। একটি সফল বিপ্লবের পর বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আমরা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি বটে, কিন্তু সেই অর্থে কি বিপ্লবের মূল্যবোধ ও চেতনার সমান্তরাল কোনো পরিবর্তন হয়েছে এখনো? কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের পরও আমরা ফরাসি বিপ্লব-পরবর্তী সংস্কারের মতো কিছু করতে পেরেছি এক মাসের বেশি সময় পরও? ঢিমেতালে কিছু কিছু হচ্ছে বটে তবে তা মোটেও আশা জাগানিয়া নয়।
কেউ কেউ এটাকে মাত্র এক মাসের আন্দোলনের ফসল বলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। কিন্তু এই এক মাস ছিল সাড়ে ১৭ বছরের ধারাবাহিক বিপ্লবের চূড়ান্ত ধাপ। আমাদের ফ্যাসিবাদ চিনিয়েছিলেন সম্পাদক মাহমুদুর রহমান তার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি' শীর্ষক কালজয়ী প্রতিবেদনের মাধ্যমে।
একটি জনবিপ্লব সকলের অংশগ্রহণেই সফল হয়। এই অভূতপূর্ব বিপ্লবে পতিত ফ্যাসিস্ট আর তার দোসররা ছাড়া সবাই অংশগ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এবং জামায়াত পূর্ণ জনশক্তি নিয়ে মাঠে ছিল। উচ্চ মধ্যবিত্ত হতে নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র, নারী পুরুষ, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র জনতা, মূর্খ হতে বুদ্ধিজীবী, সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দৈনিক মজুরির শ্রমজীবী রিকশাওয়ালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এই বিপ্লবের গর্বিত অংশীদার। সপরিবারে মানুষ বিপ্লবে যোগ দিয়েছে। কেউ ছিল সশরীরে, কেউ অনলাইনে, কেউ দিয়েছে আর্থিক ও কারিগরি সাপোর্ট। কবি লিখেছেন কবিতা, সুরকার দিয়েছেন সুর, গায়ক গেয়েছেন জাগরণী গান, শিল্পী এঁকেছেন বিপ্লবের ছবি, গ্রাফিতি। তবেই তো জেগেছে সবাই। পালিয়েছে ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার। শফিক রেহমানের ভাষায় বীর উত্তম পলাতক।
পতিত ফ্যাসিস্টের ল্যাসপেন্সাররা (শাগরেদ) ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে আর ফ্যাসিবাদবিরোধীরা নিজেরা নিজেরা লড়াই করছে। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তারা অবস্থান করছে। মিডিয়ায় এখনো তারা আধিপত্য বজায় রেখে অবস্থান করছে। ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনের সকল চেষ্টা ল্যাসপেন্সার মিডিয়া হাউসগুলো করছে। গণহত্যার ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে তারা অগুরুত্বপূর্ণ বিচ্ছিন্ন খবর দিয়ে, মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে তথ্য সন্ত্রাস করে যাচ্ছে নিয়মিত। বাক স্বাধীনতার নামে তথ্য সন্ত্রাসের অনুমতি দেওয়া যায় না। জনগণ বাকস্বাধীনতা চায়, তথ্য প্রবাহের নিশ্চয়তা চায়, তারা চায় মিডিয়া বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক সংবাদ পরিবেশন করুক। পাশাপাশি তারা তথ্য সন্ত্রাস ও হলুদ সাংবাদিকতার অবসানও চান।
গণহত্যাকারী গণশত্রুদের গ্রেফতারের অগ্রগতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। ডিবি হারুন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আরাফাত, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ এর গ্রেপ্তার নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তাদের কেউ কেউ সরকারের সহযোগিতায় বিদেশ পালিয়ে গিয়েছে মর্মেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়গুলোর সঠিক ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার জনগণের রয়েছে।
অলিগলি পাড়া মহল্লায় এখন নতুন নতুন সমন্বয়ক তৈরি হচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। কিশোর গ্যাং ও পলাতক ছাত্রলীগ এদের ভিড়ে মিশে যাচ্ছে, ক্রাইম করছে।
ষড়যন্ত্র থেমে নেই। সংখ্যালঘু ইস্যু, বিচার বিভাগ ক্যু এবং আনসার বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর আবারো কৃত্রিমভাবে সংখ্যালঘু ইস্যু সৃষ্টি করে, উস্কানি দিয়ে মাজার ভেঙ্গে এবং তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে তারা। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ইশতিয়াক কর্তৃক গার্মেন্টসকর্মীদের উদ্দেশে উস্কানিমূলক বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তারা বিএনপি সেজে ষড়যন্ত্র করছে। আর এদিকে প্রশাসনে নতুন পদায়নেও বড় পদ পাচ্ছে, প্রমোশন পাচ্ছে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ল্যাসপেন্সাররা। ফ্যাসিবাদী মানসিকতার লোক নিয়োগ পেয়েছে শিল্পকলা একাডেমির ডিজি হিসেবে।
'র'-এর নির্দেশনায় বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হচ্ছে। যখন সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস জরুরি তখন এসব দ্বন্ধ লুকায়িত ফ্যাসিস্টকেই সুবিধা দিবে। এখনো শহীদদের তালিকা হয়নি।
কিছু পরিবর্তন যে হয়নি তা নয়। বিশেষ করে বিচারবিভাগে বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে। এটা আশাব্যঞ্জক। কিন্তু আমলাতন্ত্র ও পুলিশ প্রশাসনে কি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে? নানাবিধ ঘটনায় আশঙ্কা জাগে। নানা কু ডাকে মনে। পতিত ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল পতিত স্বৈরাচারের এরশাদের দল। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং ১০ বছর পরের আমি ডামি নির্বাচনের অন্যতম সহযোগী ছিল জাপা। জাপার সাথে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হতাশ করেছে বিপ্লবীদের।
আয়না ঘর হতে উদ্ধার হয়েছেন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল অব. আমান আযমি এবং ব্যারিস্টার আরমান। কিন্তু ইলিয়াস আলীসহ শত শত ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ। আয়নাঘরগুলোর বিভিষিকাময় রহস্য জাতির সামনে উন্মোচন করা হোক। বাকশালি সংবিধান জনগণ চায় না। দেশের বেশিভাগ জনগণের বিশ্বাস মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নতুন সংবিধান জনগণের প্রত্যাশা।
জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবি উঠেছে ফ্যাসিবাদবিরোধী মহল হতে। খুবই যৌক্তিক দাবি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে এই অঞ্চলের মানুষের স্বার্থবিরোধী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিত এই কবিতা যাতে প্রিয় ’বাংলাদেশ’ শব্দটিও নেই, তাকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে চায় না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ধর্ম উপদেষ্টা ইতোমধ্যে বিষয়টিকে বিতর্কিত বলে দাবিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে গণভোটের আয়োজন হলে আর কোনো বিতর্ক থাকে না। সরকার গণভোটের বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে।
সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে ছয়টি কমিশন গঠন হয়েছে তা আশাব্যঞ্জক। তবে কমিশনের প্রধান হিসেবে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে তারা সবাই ফ্যাসিবাদবিরোধী বিপ্লবী চেতনা ধারণ করেন কিনা সে প্রশ্ন রয়েই গেল।
বিরাজনীতিকরণের একটি সুর উঠে মাঝে মাঝে। এটি ফ্যাসিবাদী আচরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো রাজনীতি মুক্ত নাম দিয়ে সেখানে বিভিন্ন নেতৃত্বে সুযোগ নিচ্ছে পতিত ফ্যাসিস্ট দলের কর্মীরা এবং তাদের সহযোগী কিছু বাম দলের ছাত্র কর্মীরা। এসব অশনি সংকেত।
হাজার শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদ মুক্ত আজকের এই বাংলাদেশ। এটা ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না নতুন ফ্যাসিস্ট আচরণ দ্বারা। রাজনৈতিক কর্মীরা পূর্ণ জনশক্তি নিয়ে মাঠে ছিল, বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে। শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে শত শত। ছাত্ররা আকাশ হতে টুপ করে নাজিল হয়নি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী বড় দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক ছিল বেশিভাগ।
বিরাজনীতিকরণ চাই না। জোর করে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ চাই না। এসব ফ্যাসিবাদী আলাপ বন্ধ করা প্রয়োজন। ধর্মের প্রভাব না থাকলে নৈতিকতা বিষয়টিই হারিয়ে যাবে রাজনীতি হতে। ধর্মীয় রাজনীতি কেউ পছন্দ না করলে সেটা জানানোর সুযোগ আছে নির্বাচনে। পতিত ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের চেষ্টাও দেখা যায় মাঝে মাঝে। শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি পরিচয়ের আড়ালে যারা ফ্যাসিস্ট গণহত্যাকারী গণবিরোধী সরকারের দোসর ছিল, গণহত্যায় এবং ভোট চুরিতে অংশগ্রহণ ছিল তাদের যখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল তখন তাদের শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি পরিচয়কে ফোকাস করে তার অপরাধ ঢেকে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু মিডিয়া। জার্মানীর এডলফ হিটলার বড় মাপের চিত্রশিল্পী ছিলেন। কিন্তু পতনের পর ফ্যাসিস্ট এডলফ হিটলারের সকল স্মৃতিচিহ্ন জার্মানি হতে সমূলে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। জার্মানিতে এখনো এডলফ নাম রাখা নিষিদ্ধ। তার প্রশংসা সেখানে ট্যাবু হিসেবে ধরা হয়। পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ মূলত কোনো রাজনৈতিক দল নয়, এটা হচ্ছে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের আস্তানা।
আমরা চাই অপরাজনীতি বন্ধ হোক। গণহত্যাকারী, ধর্ষক, লুটেরাদের রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ হোক।
আমরা চাই বাক স্বাধীনতা, বন্ধ হোক তথ্য সন্ত্রাস।
আর এসবের জন্য প্রয়োজন ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য। ঐক্যের প্রয়োজন এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ফ্যাসিবাদ হটানোর সময়ের মতো ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য আমাদের বজায় রাখতে হবে। ঐক্য থাকলে সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে ইনশাআল্লাহ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা