মোদির একদলীয় রাষ্ট্রনীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন ভোটাররা
- ০৬ জুন ২০২৪, ০০:০৫
বুথফেরত জরিপে বিরোধীদের নজিরবিহীন পরাজয় দেখানো হয়েছিল। এর মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফলে প্রায় ইতিটানা হয়। বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী জোট সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে। মোদির সমালোচক ও বিরোধীদের মতে, ভারত একটি ডি-ফ্যাক্টো একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার পথে ছিল। এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদির লক্ষ্য ছিল ৪০০ আসনে জয়। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ফলাফল আসার পর দেখা গেল ভিন্ন দৃশ্যপট। মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি এমনকি সরকার গঠনের জন্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হয় তাও পায়নি।
এক দশক আগে ক্ষমতায় আসা মোদিকে এই প্রথমবার সরকার গঠনের জন্য জোটের অংশীদারদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য বিজয় হিসেবে দেখছেন বিরোধীরা। তাদের মতে, জনগণ মোদির হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিশনকে আংশিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এর আগের বারের চেয়ে ৬৩টি আসনে হেরেছে মোদির দল। ২৪০টিতে জয় পেয়েছে বিজেপি, যা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২ আসনের চেয়ে কম।
বিরোধী জোট জয় পেয়েছে ২৩৫ আসনে। তবে বিজেপির অংশীদাররা আরো ৫২টি আসনে জিতেছে। যে ব্যক্তি দাবি করেছেন তাকে স্বয়ং ভগবান পাঠিয়েছেন বিশেষ উদ্দেশ্য অথবা বুথফেরত জরিপে যাকে বিজয়ী দেখানো হলো তার জন্য এই ফলাফল বিব্রতকর বটে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রতাপ ভানু মেহতা মঙ্গলবার রাতে লিখেছেন, বিজেপির সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে অক্ষমতা মোদির কর্তৃত্বের জন্য হতাশাজনক।
তিনি বলেছেন, মোদি ইতিহাসের অদম্য বাহন নন, আজকে তিনি অন্যদের মতোই একজন রাজনীতিবিদ। জনগণ তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদির যে জনপ্রিয়তা দেখা যায়, তা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি হিন্দু জাতীয়তাবাদে গুরুত্ব দেন মোদি। দেশটিতে প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। মোদির নেতৃত্বেই ১৪০ কোটি মানুষের দেশটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এগিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। যদিও এত উন্নয়নের মধ্যেও প্রধান সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। ভারতের জন্য অন্তত পরবর্তী এক হাজার বছরের ভিশনের কথা বলেছেন মোদি। তা ছাড়া ভারতকে ২০৪৭ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত করার কথাও জানিয়েছে মোদি।
ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু মোদি এরই মধ্যে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার কথা স্পষ্ট করেছেন। সম্প্রতি তিনি বাবরি মসজিদের জায়গায় বিতর্কিত রাম মন্দিরের উদ্বোধন করেছেন। নতুন দিল্লিভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি জেরাথ বলেছেন, মোদিকে এখন তার সব উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনায় কিছুটা ধীরগতিতে যেতে হতে পারে।
ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যেতে হলে তাকে সাবধানে চলতে হবে। কারণ তিনি এখন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বিরোধীদের দমনে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের এক সময়ের স্বাধীন গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে।
চলতি বছরের মার্চে দিল্লির আম আদমি পার্টির নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দু কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর দিল্লিতে তার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। এমনকি তাকে গ্রেফতারের বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করা হয়। যদিও তা অস্বীকার করে বিজেপি। কিন্তু গত মাসে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী। এতে আরো চাঙা হয় বিরোধীদের মনোবল। ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ থাকা সত্ত্বেও অনেক বিরোধী নেতা ঐক্যের সুরে কথা বলেন। তারা এটিকে সংবিধান রক্ষার জন্য জীবন মরণ লড়াই হিসেবে বিবেচনা করেছেন।
সমালোচকরা বলছেন, মোদির সরকারের সময় ধর্মীয় বিভাজন বেড়েছে। বিশেষ করে ইসলামোফোবিয়া বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। দেশটিতে ২০ কোটির ওপরে মুসলিম রয়েছে। তার শাসনামলে ধর্মীয় সহিংসতা বেড়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় মোদির বিরুদ্ধে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানোর অভিযোগ ওঠে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছেন মোদি। কিন্তু লোকসভার ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভোটারদের একটি বিশাল অংশ মোদির ভিশনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিরোধী জোট আম আদমি পার্টির সঞ্জয় সিং বলেছেন, জনগণ ঘৃণা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের ফলাফলের মাধ্যমে জনগণ বার্তা দিয়েছে যে, বিজেপির ১০ বছরের শাসনামলে তারা ক্লান্ত এবং তারা পরিবর্তন চায়।