১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪ মাঘ ১৪৩১, ১৭ রজব ১৪৪৬
`

মন্দা-ঋণ-বেকারত্ব কাটানোর লড়াইয়ে চীন

অর্থনীতির গতি বাড়াতে গত বছরের শেষ দিকে বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করে চীন সরকার
-

আবাসন বাজারের দীর্ঘস্থায়ী মন্দা, সরকারের বিপুল ঋণ এবং যুব বেকারত্ব কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন। অর্থনীতির গতি বাড়াতে গত বছরের শেষ দিকে বেশ কয়েকটি প্রণোদনা ব্যবস্থা চালু করে চীন সরকার। দেশটির পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রধান ই কং বলেছেন, ২০২৪ সালে যে অর্থনৈতিক সাফল্য এসেছে তা অনেক ‘কষ্টের ফল’।
বেইজিং অতীতে তার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে খুব কমই ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি এ হারের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েই রেখেছিলেন। ঋণ নেয়ার খরচ কমে যাওয়া এবং রফতানি বাড়ার কারণে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্ব ব্যাংক।
৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের যে হুমকি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প দিয়ে রেখেছেন, সেটাও গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যে নিজেদের প্রস্তুতি শুরু করছেন। তবে চীনের পরবর্তী বছরের প্রবৃদ্ধির অর্জনের পথে এ শুল্কই কেবল বাধা নয়। ক্রেতাদের ভোগের প্রবণতা কমায় দেশটির ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বেইজিং সুদের হার কমানোয় চীনা ইউয়ান দুর্বল হতে থাকবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সামনে ট্রাম্পের শুল্কের চাইতেও মোটাদাগে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ২০২৫ সালে চীনের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ার সতর্কবার্তা দিন দিন জোরালো হচ্ছে। গত বছরের প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি রফতানি এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
চীন মন্দা এড়াতে শিল্পখাতে নির্ভরতা বাড়াচ্ছে; দেশটি রেকর্ডসংখ্যক বৈদ্যুতিক বাহন, থ্রিডি প্রিন্টার এবং শিল্প রোবট রফতানি করছে। চীনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত পণ্য তৈরির অভিযোগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা দেশীয় কর্মসংস্থান ও ব্যবসা রক্ষার জন্য চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা রফতানিকারকরা এখন বিশ্বের অন্যান্য অংশে মনোনিবেশ করতে পারেন। তবে সেই দেশগুলো বেইজিংয়ের জন্য হতে পারে উদীয়মান বাজার; যাদের উত্তর আমেরিকা কিংবা ইউরোপের মতো অত চাহিদা নেই।
এর ফলে চীনা ব্যবসায় প্রভাব পড়তে পারে। ফলে জ্বালানি ও কাঁচামাল সরবরাহকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শি চাইছেন, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনকে বিশ্বের সস্তা পণ্যের কারখানা থেকে একটি উচ্চ প্রযুক্তির শক্তিতে রূপান্তর করতে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান শুল্কের মুখে কিভাবে উৎপাদন খাত এত বড় প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারে তা স্পষ্ট নয়।
চীনে পারিবারিক সম্পদ ব্যাপকভাবে সম্পত্তি বাজারে বিনিয়োগ করা হয়। আবাসন শিল্পে সঙ্কটের আগে চীনের অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এ খাত নির্ভর ছিল- বিল্ডার ও ডেভেলপার থেকে শুরু করে সিমেন্ট উৎপাদক এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইন খাতে লাখ লাখ কর্মী ছিল। বেইজিং আবাসন বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য বেশ কয়েকটি নীতি বাস্তবায়ন করেছে। দেশটির আর্থিক বাজারের নজরদারি সংস্থা চায়না সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশন (সিএসআরসি) বলেছে, তারা সংস্কারকে জোরালোভাবে সমর্থন করবে।
কিন্তু এখনো অনেক বাড়ি এবং বাণিজ্যিক সম্পত্তি খালি পড়ে আছে; চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত সরবরাহ থাকায় এ সবের দাম কমছে।
চলতি বছর আবাসন বাজারের মন্দা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকিং জায়ান্ট গোল্ডম্যান স্যাকস বলছে, এ মন্দা চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর ‘বহু বছরের টানাপড়েনের ফল’ হিসেবে কাজ করবে।
২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে খানার অবদান মাত্র ২৯ শতাংশ, যা মহামারীর আগে ছিল ৫৯ শতাংশ। বেইজিংয়ের রফতানিতে মনোযোগ বাড়ানোর এটিও একটি কারণ। দেশের ভেতরে ভোগব্যয় কমে যাওয়ায় নতুন গাড়ি, বিলাসবহুল পণ্য এবং প্রায় সব কিছু রফতানির মাধ্যমে অর্থনীতির সেই ক্ষতি পূরণ করতে চায় দেশটি।
সরকার ভোগ্যপণ্য ট্রেড-ইনের মতো কর্মসূচিও চালু করেছে, যেখানে মানুষ তাদের ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ এবং রাইস কুকার বিনিময় করতে পারে। তবে অর্থনীতির গভীরতম সমস্যাগুলোর সমাধান না করে কেবল এ ধরনের পদক্ষেপই পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য যথেষ্ট কি না তা নিয়ে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, ভোগব্যয় আগের জায়গায় ফেরাতে কোভিড মহামারীর আগের সময়ের চাইতে মানুষের পকেটে বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বৃহত্তর চীন এবং উত্তর এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ শুয়াং ডিং বলেন, ‘যদি বেসরকারি খাত বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম শুরু করে তবে আয় এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে এবং ভোগের প্রশ্নে মানুষ আরো আত্মবিশ্বাসী হবে।’
সঞ্চয় ও ব্যয়কে প্রভাবিত করেছে অত্যধিক সরকারি ঋণ এবং বেকারত্বও। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মহামারীর আগের তুলনায় তরুণদের বেকারত্বের হার বেড়েছে এবং মজুরি বৃদ্ধি থমকে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট শি অত্যাধুনিক শিল্পে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যাকে সরকার ‘নতুন উৎপাদনশীল শক্তি’ বলে বর্ণনা করছে। এখন পর্যন্ত তা চীনকে সৌর প্যানেল এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে শীর্ষ দেশ হতে সহায়তা করছে। গত বছর জাপানকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বৃহত্তম গাড়ি রফতানিকারক দেশ হয়েছে চীন।
কিন্তু দুর্বল অর্থনৈতিক চিত্র, শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং অন্যান্য ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে চীনে বিনিয়োগের আগ্রহ হারাচ্ছেন বিদেশী ব্যবসায়ীরা। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাশঅ্যাওয়ের স্টেফানি লিউং বলেন, এটি বিদেশী বা দেশীয় বিনিয়োগের বিষয় নয়; বিনিয়োগকারীরা আসলে ব্যবসায় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না।
‘তারা আরো বৈচিত্র্যময় বিনিয়োগকারীদের সমাগম দেখতে চান।’ এসব কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অর্থনীতিকে সহায়তার জন্য চীন সরকারের নেয়া পদক্ষেপ কেবল সম্ভাব্য নতুন মার্কিন শুল্কের প্রভাবকে আংশিকভাবে ঠেকাবে।
গোল্ডম্যান স্যাকসের চীনবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হুই শান সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘বেইজিংকে হয় বড়, সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে অথবা মেনে নিতে হবে যে অর্থনীতি আর দ্রুত গতিতে বাড়বে না। আমরা আশাকরি, তারা প্রথমটি বেছে নেবে।’
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের শুয়াং ডিং বলেন, সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে চীনকে তার আবাসন বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হবে এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
গবেষণা সংস্থা চায়না ডিসেন্ট মনিটরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে চীনে শ্রমিক ও আবাসন মালিকদের নেতৃত্বে ৯০০টির বেশি বিক্ষোভ হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি।
অর্থনৈতিক অসন্তোষ এবং সম্পদের ক্ষতির ফলে এ ধরনের সামাজিক টানাপড়েন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য উদ্বেগের কারণ হবে। সব মিলিয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি চীনকে একটি বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত করেছে এবং আরো সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেশটির নেতাদের মোটাদাগে ভিন্নমতের ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করেছে।


আরো সংবাদ



premium cement