জিমি কার্টার : বাদামচাষি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট
- বিবিসি
- ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
জিমি কার্টার বেঁচে ছিলেন ১০০ বছর; আমেরিকান জনগণের কাছে কখনো মিথ্যা না বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি পৌঁছেছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির পর যুক্তরাষ্ট্রে তখন খুব অস্থির সময়। জর্জিয়ার সাবেক এই বাদামচাষিকেই মার্কিন নাগরিকরা তাদের নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন।
বিশ্ব মঞ্চে তার ভূমিকা কী ছিল? মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে এক ঐতিহাসিক চুক্তির মধ্যস্থতা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ইরানের জিম্মি সঙ্কটের সুরাহা করতে এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান ঠেকাতে তাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল। ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টার হোয়াইট হাউজে থাকতে পেরেছিলেন কেবল এক মেয়াদে। ১৯৮০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি।
সে সময় তার জনপ্রিয়তা এতটাই নেমে গিয়েছিল যে, নির্বাচনে তিনি জিততে পেরেছিলেন কেবল ছয়টি অঙ্গরাজ্যে। হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায়ের পর হারানো সুনাম পুনরুদ্ধারে মনোযোগী হন কার্টার। শান্তি, পরিবেশ ও মানবাধিকারের জন্য কাজ করে যান বিরামহীন, যা তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার এনে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকা জিমি কার্টার গত অক্টোবরেই তার একশতম জন্মবার্ষিকী পালন করেন। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গত ১৯ মাস তাকে নিজের বাড়িতে কাটাতে হয়েছে হসপিস কেয়ারে।
জেমস আর্ল কার্টার জুনিয়র ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জর্জিয়ার ছোট্ট শহর প্লেইনসে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবাই প্রথমে বাদামের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, আর মা লিলিয়ান ছিলেন একজন নার্স। স্কুলজীবনে কার্টার ছিলেন একজন তারকা বাস্কেটবল খেলোয়াড়। পরে তিনি যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে। সাত বছর কাজ করে তিনি সাবমেরিন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি পান। ওই চাকরিতে থাকাকালে বিয়ে করেন বন্ধুর বোন রোজালিনকে।
১৯৫৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরতে কার্টার নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফেরেন। রাজনীতিতে তার প্রবেশ একেবারে তৃণমূল থেকে। জর্জিয়া সেনেটের সদস্য হওয়ার আগে তিনি স্থানীয় স্কুল ও লাইব্রেরি বোর্ডের নির্বাচনগুলোতে জয়ী হন। দুই দফায় স্টেট সিনেটে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭০ সালে জর্জিয়ার গভর্নর হন কার্টার। তখন থেকে নাগরিক অধিকারের পক্ষে তিনি সরব হয়ে ওঠেন।
শপথ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, বর্ণবৈষম্যের দিন পার হয়ে গেছে।’ তিনি ক্যাপিটল ভবনের দেয়ালে মার্টিন লুথার কিংয়ের ছবি টানান এবং আফ্রিকান আমেরিকানরা যেন সরকারি অফিসে নিয়োগ পান, তা নিশ্চিত করেন। তবে গর্ভপাত আইনের ক্ষেত্রে নিজের উদার নীতির সাথে দৃঢ় খ্রিষ্টান বিশ্বাসের ভারসাম্য রাখা কঠিন হয়ে উঠেছিল জিমি কার্টারের কাছে। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে তিনি সমর্থন করেছিলেন; কিন্তু সেজন্য তহবিল বাড়াতে অস্বীকার করেছিলেন।
১৯৭৪ সালে কার্টার যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চালাতে শুরু করেন, তখনো আমেরিকা উত্তাল ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে। পেশাদার রাজনীতিবিদের বদলে নিজেকে তিনি একজন সাধারণ বাদামচাষি হিসেবেই তুলে ধরেন জনগণের সামনে। শুরুতে জনমত জরিপগুলো ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তার মাত্র চার শতাংশ সমর্থনের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত ৯ মাস পর তিনি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডকে হারিয়ে দেন।
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা হাজার হাজার ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেন। রিপাবলিকান সেনেটর ব্যারি গোল্ডওয়াটার এ বিষয়টিকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘একজন প্রেসিডেন্টের জন্য সবচেয়ে লজ্জাজনক কাজ’ হিসেবে। কার্টারও স্বীকার করেছিলেন, এটা ছিল তার জন্য সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত। তিনি তার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের নিয়োগ দিয়েছিলেন।
তিনিই প্রথম বিশ্বনেতা যিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি হোয়াইট হাউজের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়েছিলেন যা পরে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান সরিয়ে ফেলেন। আমেরিকার অর্থনীতি মন্দায় পড়ার সাথে সাথে কার্টারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে শুরু করে। তিনি সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা করলেও কংগ্রেসের বাধায় বাস্তবায়ন করতে পারেননি। তবে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিনের মধ্যে শান্তি চুক্তির মধ্যস্থতা করে কার্টারের মধ্যপ্রাচ্য নীতি বিজয় ঘটে।
অবশ্য সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতা থাকেনি। ইরানে মার্কিন দূতাবাসে জিম্মি সঙ্কট এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিষয়গুলো কার্টারকে উপহার দিয়েছে তিক্ত অভিজ্ঞতা। কার্টার তেহরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং জিম্মি আমেরিকানদের মুক্ত করতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। একপর্যায়ে জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে আটজন আমেরিকানের প্রাণ যায়।
ওই ঘটনাই তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আশা শেষ করে দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে দলীয় প্রার্থিতার দৌড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও নেনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডির বিরুদ্ধে ৪১ শতাংশ পপুলার ভোট পান। কিন্তু তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী রোনাল্ড রিগ্যানকে পরাজিত করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান জিমি কার্টার। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে গুরুতর ও সার্বজনীন সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রতম মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান।’
অবসরে কার্টার একটি সাধারণ জীবনধারা বেছে নিয়েছিলেন। তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি রাজনীতিতে প্রবেশের আগে যে বাড়িতে থাকতেন, অবসরের পর সেখানেই ফিরে গিয়েছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাবে, কার্টারদের বাড়ির দাম ১ লাখ ৬৭ হাজার ডলার, যা তার নিরাপত্তার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিক্রেট সার্ভিসের গাড়ির দামের চেয়েও কম। ২০১৫ সালে তার ক্যান্সার শনাক্ত হয়। তার বাবা-মা ও তিন বোনও একই রোগে মারা গিয়েছিলেন।
সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রী ১৯৮৪ সালে শুরু করা দাতব্য কর্মকাণ্ডে চার হাজারের বেশি বাড়ি সংস্কারে সহায়তা করেন। সেই সাথে প্লেইনসের মারানাথা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে শিক্ষকতা অব্যাহত রাখেন। কার্টারের স্ত্রী রোজালিন ২০২৩ সালের নভেম্বরে মারা যান। মৃত্যুর পর স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘জীবনে আমি যা কিছু অর্জন করেছি তার সবকিছুতে আমার সমান অংশীদার ছিলেন আমার স্ত্রী।’
তার রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে উদারপন্থার ছাপ যেমন ছিল, তেমনি তিনি ধর্ম বিশ্বাস থেকে সরে যাননি। কার্টার বলেছিলেন, ‘ধর্ম বিশ্বাস ও জনসেবা আলাদা করা যাবে না। আমি কখনোই ঈশ্বরের ইচ্ছা আর আমার রাজনৈতিক দায়িত্বের মধ্যে কোনো বিরোধ খুঁজে পাইনি। আপনি একটা লঙ্ঘন করলে, আরেকটাও লঙ্ঘিত হবে।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা