গাজায় জাতিগত নির্মূল ঠেকাতে বিশ্বকে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে : গুতেরেস
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০১ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইল ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান চালাতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। গাজার উত্তরাঞ্চলে ইসরাইলি বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণের মুখে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি বাড়তে থাকায় গুতেরেস এ সতর্কবাণী উচ্চারণ করলেন। গুতেরেসের এ সতর্কবার্তার আগে গত মঙ্গলবার গাজার বেইত লাহিয়ায় ইসরাইলের এক হামলাতেই অন্তত ৯৩ জন নিহত হন। জাতিসঙ্ঘ বলেছে, গত এক সপ্তাহে গাজায় অন্তত যে সাতটি হামলায় অনেকের প্রাণহানি ঘটেছে, এটি তার একটি।
গাজায় একদিকে প্রাণহানি বেড়েছে, অন্যদিকে যুদ্ধ শুরুর পর ইসরাইলি বাধায় এ পর্যন্ত ত্রাণসরবরাহ সর্বনি¤œ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় গাজার বাসিন্দাদের অন্তত এ উপত্যকার অংশবিশেষ থেকে হলেও ইসরাইল তাড়াতে চাইছে, এমন অভিযোগ বাড়ছে। কলাম্বিয়ায় বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সম্মেলন ‘কপ১৬এর ফাঁকে বক্তব্য দেয়ার সময় গাজা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ইঙ্গিত দেন যে এ পর্যন্ত গাজায় ‘জাতিগত নির্মূল’ ঠেকিয়ে রাখা গেছে। ইসরাইলের প্রচণ্ড চাপের মুখে গাজার বাসিন্দারা বাড়িঘর ছাড়তে রাজি না হওয়ায় এবং সেখান থেকে তাদের গণহারে ভিন্ন স্থানে স্থানান্তর আরবরা মেনে না নেয়ায় এটি সম্ভব হয়েছে।
এদিকে গুতেরেস দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘সম্ভবত (ইসরাইলের) অভিপ্রায় হলো, ফিলিস্তিনিরা গাজা ছেড়ে চলে যাক এবং সেখানে অন্যরা দখলদারি প্রতিষ্ঠা করুক।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে এখনো সেটি হয়নি এবং আমি তাদের সাহস ও মনোবল এবং আরব বিশ্বের দৃঢ়প্রত্যয়ের শ্রদ্ধা জানাই।’ জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেন, ‘গাজার বাসিন্দারা যাতে নিজেদের ভূমিতে থাকতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তাদের সহায়তা করতে ও সম্ভাব্য জাতিগত নির্মূল ঠেকাতে আমরা সম্ভব সবকিছু করব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া না হলে জাতিগত ওই নির্মূল সংঘটিত হতে পারে।’ মহাসচিবের এ বক্তব্যের আগে গত সপ্তাহে জর্দানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনকে বলেছেন, গাজায় এরই মধ্যে জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু হয়েছে। অবশ্য পদ্ধতিগত উপায়ে গাজার বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী।
ইসরাইলি হামলায় আরো ১০২ ফিলিস্তিনি নিহত
গাজাতে ইসরাইলি হামলায় আরো ১০২ জন নিহত এবং আরো ২৮৭ জন আহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা ৪৩ হাজার ১৬০ জন ছাড়িয়ে গেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি।
বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলু। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এ পর্যন্ত ৪৩ হাজার ১৬৩ জন নিহত এবং এক লাখ এক হাজার ৫১০ জন আহত হয়েছেন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো ১০ হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ রয়েছেন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে।
সৈন্য সঙ্কটে যুদ্ধ চালাতে হিমশিম খাচ্ছে ইসরাইল
যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর রিজার্ভ সৈন্যরা। এ অবস্থায় দেশটি নতুন সৈন্য সংগ্রহেও সমস্যার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে তারা যখন লেবাননে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করেছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে প্রায় তিন লাখ রিজার্ভ সৈন্যকে ডাকা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশই ৪০ বছরের বেশি বয়সী, যাদের সাধারণত ছাড় দেয়া হয়ে থাকে।
ইসরাইলে পুরুষ ও নারীদের জন্য ১৮ বছর বয়স থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক, যদিও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। দেশটি বর্তমানে গাজায় হামাস এবং লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাচ্ছে। গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজায় আগ্রাসন শুরু করার পর থেকে ইসরাইল ৩৬৭ সেনা হারিয়েছে। এছাড়া গত ৩০ সেপ্টেম্বর লেবাননে অভিযান শুরুর পর থেকে নিহত হয়েছেন ৩৭ ইসরাইলি সেনা। এ অবস্থায় ইসরাইলের রিজার্ভ সৈন্যদের ডিউটির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। অনেক সৈন্য অভিযোগ করেছেন, তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না।
আরিয়েল সেরি-লেভি নামে একজন ইসরাইলি রিজার্ভ সৈন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, আমরা ডুবে যাচ্ছি। তিনি জানান, গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে তাকে চারবার ডাকা হয়েছে। বর্তমানে যুদ্ধ চালানোর পক্ষে যারা আছেন, তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এই ইসরাইলি সৈন্য। তিনি বলেছেন, আমাদের এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, কারণ আমাদের সৈন্যের অভাব হচ্ছে। আরেক রিজার্ভ সৈন্য বলেন, ক্লান্তি ও নৈতিক অবসাদের কারণে আমি আমার চাকরি হারিয়েছি। অনেক ফ্রিল্যান্সার যুদ্ধের কারণে কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও ইসরাইলি সরকার রিজার্ভ সৈন্যদের জন্য একটি ন্যূনতম আয়ের গ্যারান্টি দেয়। সম্প্রতি দুই হাজার রিজার্ভ সৈন্যের স্ত্রীর একটি খোলা চিঠিতে লিখেছেন, যাদের সেবা দিতে হচ্ছে তাদের জন্য চাপ কমানো প্রয়োজন।
এ বছর ২৫০ দিন যুদ্ধ করেছেন ৫২ বছর বয়সী ডেভিড জেনু। তিনি বলেন, এটি দেশের সেবা করার সম্মান এবং আমি যতদিন পারি তা চালিয়ে যাবো। তবে, যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে আমাদের সৈন্যের অভাব রয়েছে। সৈন্য সঙ্কটে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এখন একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। এটি দেশটির নিরাপত্তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল
গাজায় ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হামলার সময় ফিলিস্তিনিদের ‘মানবঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সাথে এক সেনার সাক্ষাৎকারে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পায়। জেরুসালেম পোস্টের এক খবর থেকে এ তথ্য জানা যায়।
সেনা সদস্যটি জানান, সামরিক ইউনিটগুলো ফিলিস্তিনিদের সামনে রেখে বিপজ্জনক ভবনগুলোতে প্রবেশ করে তল্লাশি চালাচ্ছে, যা মানবিক নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক আইনকে লঙ্ঘন করে। সেনাটি জানান, তাদের ইউনিটে দু’জন ফিলিস্তিনি তরুণকে আটক করে এবং সামনে রেখে বিপজ্জনক ভবনে প্রবেশ করে। এভাবে ‘মানবঢাল’ ব্যবহার করে একাধিক অভিযান চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। গাজায় অভিযানের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনিদের এমনভাবে ব্যবহারের বিষয়টি তার কাছে মানবতার প্রতি এক বড় অবিচার বলে মনে হয়েছে।
ওই সেনা আরো জানান, গাজার বিভিন্ন স্থানে-উত্তর গাজা, গাজা সিটি, খান ইউনুস ও রাফা এলাকায় ফিলিস্তিনিদের এভাবে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাঁচ ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীও একই অভিযোগ করেছেন। মানবাধিকার সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স, যা মূলত সামরিক বাহিনীর অনিয়ম প্রকাশে কাজ করে, তারা এই ঘটনাটি সিএনএনের সাথে শেয়ার করেছে। উল্লেখ্য, মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, কোনো দেশের সামরিক বাহিনী বেসামরিক মানুষকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। ২০০৫ সালে ইসরাইলের হাইকোর্টও এই চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে গাজায় এই বিধিনিষেধ কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা