২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সঙ্গীর ফোনে নজরদারির সফটওয়্যার যখন মাথাব্যাথার কারণ

- ছবি : সংগৃহীত

হঠাৎ একদিন অ্যামি'র (ছদ্মনাম) মনে হল যে, তার স্বামী তার বন্ধুদের বিষয়ে সব গোপন খবর জানতে শুরু করেছে। অ্যামি অবাক হয়ে যখন তার স্বামীকে প্রশ্ন করতেন যে সে কীভাবে তার এবং তার বন্ধুদের সম্পর্কে এতসব তথ্য জানে!

তখন তার স্বামী বলতো এসব, সেই তাকে একসময় বলেছে এবং পরে হয়তো ভুলে গেছে। অ্যামি বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করে, সে কখন কোথায় থাকে সেটিও জানে তার স্বামী।

"কখনো কখনো সে বলেছে যে সে হঠাৎ কোথাও যাবার সময় আমাকে কোনও এক বন্ধুর সাথে ক্যাফেতে দেখেছে। তখন তাকে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করি, আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম। এমনকি আমার বন্ধুদের ওপর থেকেও।"

"মাসখানেকের মধ্যে আমাদের বৈবাহিক জীবনটিই দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। এর পরিণতি আসে একটি পারিবারিক হ্যালোউইন ভ্রমণে।"

অ্যামি বলছিলেন, "হ্যালোউইন উপলক্ষে আমাদের বেড়ানোটি বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। অনেকদিন পর দারুণ একটি ছুটি কাটাচ্ছিলাম। কিন্তু সবকিছু নস্যাৎ হয়ে গেল হঠাৎই। আমার স্বামী যখন একটি ছবি দেখানোর জন্যে তার মোবাইল ফোনটি আমাকে দেন তখন একটি পপ-আপ ভেসে ওঠে ফোনের স্ক্রিনে। 'অ্যামির কম্পিউটার থেকে প্রতিদিনের রিপোর্ট দেখার জন্যে তৈরি'- এটাই ছিল সেই মেসেজে।"

ঘটনার আকস্মিকতা তাকে বিহ্বল করে তোলে। এরপর অ্যামি যখন লাইব্রেরি রুমে গিয়ে তার স্বামীর কম্পিউটার অনুসন্ধান করে স্পাইওয়্যারটা খুঁজে পায়- তখন সবকিছুই তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

'স্টকারওয়্যার' কী?
'স্টকারওয়্যার' যা কিনা 'স্পাউসওয়্যার' নামেও পরিচিত - এক ধরনের খুবই শক্তিশালী নজরদারির সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যা সাধারণত প্রকাশ্য অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায়। যেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ক্ষেত্রে।

এটি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির সমস্ত মেসেজ পড়া সম্ভব, তার ব্যবহৃত কম্পিউটারের স্ক্রিনের রেকর্ড রাখা যায়, জিপিএস অবস্থান ট্র্যাক করা যায়, ব্যক্তি কী করছে তা জানার জন্যে ক্যামেরা পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব।

সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা ক্যাসপারস্কির মতে, এ ধরনের গুপ্তচরমূলক সফটওয়্যার নিজেদের ডিভাইসে খুঁজে পাওয়া ব্যবহারকারীর সংখ্যা গত একবছরে কমপক্ষে বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

ক্যাসপারস্কির গবেষকরা বলছেন, তাদের সুরক্ষা প্রযুক্তি এ বছর এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৫৩২টি ডিভাইসে 'স্টকওয়্যার' সনাক্ত করতে পেরেছে।

সংস্থাটির প্রধান সুরক্ষা গবেষক ডেভিড এম সংখ্যাটিকে একটি বিশাল 'হিমবাহের চূড়া মাত্র' বলে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলছেন, "বেশিরভাগ মানুষ নিয়মিত তাদের ল্যাপটপ বা ডেক্সটপের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। কিন্তু তাদের মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে নয়।"

তার হিসেবে স্মার্টফোনে ক্যাসপারস্কি সুরক্ষা ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য নিয়েই ওপরের সংখ্যাটি তারা পেয়েছেন। সুতরাং প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

ক্যাসপারস্কি'র অনুসন্ধানে রাশিয়াতে সবচেয়ে বেশি 'স্টকওয়্যার' ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে। ভারত, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর জার্মানি হল এর পরের ৫টি দেশ। যুক্তরাজ্যের অবস্থান তালিকায় ৮ম।

অন্য একটি সুরক্ষা প্রতিষ্ঠান বলছে যে তারা ব্যবহারিক পদক্ষেপ নিতে পারছে সেইসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যারা মনে করছেন যে তাদের ওপর নজরদারি বা গুপ্তচরবৃত্তি করা হচ্ছে।

'ইস্ট' এর জ্যাক মুর-এর বক্তব্য, যে অ্যাপটি ব্যবহার করা হয় না সেটি ডিলিট করে দেয়াই সবচেয়ে সহজ উপায় এমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যে।

অ্যামির ক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা হল যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রযুক্তির মাধ্যমে তার ওপর নজরদারি হয়েছে, তারপর থেকে প্রযুক্তির ওপরই অবিশ্বাস জন্মে যায়- যা কিনা সম্প্রতি তিনি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন।

মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া
জেসিকা নামে আরেকজন নারী যিনি এই 'স্টকারওয়্যার' এর শিকার। তার প্রাক্তন স্বামী নিয়মিত তার টেলিফোনের বক্তব্য তার অজান্তে ধারণ করতো এবং বন্ধুদের সাথে বলা কথার বিশেষ কোনও বাক্য ব্যবহার করে জেসিকার মনেও ওপর চাপ সৃষ্টি করতো।

সে সম্পর্কটি বহু বছর আগে ভেঙ্গে গেলেও মিজ জেসিকা এখনো বন্ধুদের সাথে দেখা করার সময় নিজের ফোনটাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কাজ করেন গেমা টয়নটন। তার হিসেবে এসবক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে থাকে অনেকের উপর।

তিনি বলেন, "এটি কোনও ব্যক্তির বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। এটি তাদেরকে ফোন বা ল্যাপটপকে একধরনের অস্ত্র হিসেবে দেখতে বাধ্য করে, কারণ হয়তো সেটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে বহু মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করা থেকে দূরে সরে এসেছে।"

স্টকারওয়্যারের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করেন তিনি।

স্পাইওয়্যার সংস্থাগুলি তাদের এসব পণ্যকে 'কর্মচারী পর্যবেক্ষণ' বা 'বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণ' পণ্য হিসেবে বিজ্ঞাপিত করে থাকে।

যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই স্বামী বা স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া এমন কিছু ব্যবহার করা বেআইনি। তাই অধিকাংশ এ ধরনের কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটে এমন পণ্যের বিজ্ঞাপনে অনেককিছু এড়িয়ে যায়।

এরপরও এধরনের অন্তত একটি কোম্পানি তাদের ওয়েবসাইটে এমনসব নিবন্ধের লিঙ্ক যুক্ত রেখেছে, যেখানে এসব সফটওয়্যারকে 'স্বামী/স্ত্রী-র সাথে প্রতারণা'র মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্রিটেনের ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস বলছে, 'স্টকারওয়্যার' ব্যবহার বন্ধের কোনও নির্দিষ্ট আইন যদিও নেই তবে এই জাতীয় অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে সুরক্ষা বা হয়রানি থেকে মুক্তি দেবার আইন রয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement