মরুর উষ্ণতায় ক্ষতির মুখে কৃষি
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:২৩
গত কয়েকদিন ধরেই গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়ছে দেশ! বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। অনুভূত হচ্ছে তার চেয়েও বেশি!
দেশজুড়ে যেন মরুর উষ্ণতা! এমন পরিস্থিতি কি এবারই তৈরি হয়েছে? নাকি এই সময়ে এটি স্বাভাবিক ব্যাপার?
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বৈশাখে এটাই স্বাভাবিক তাপমাত্রা। তবে এবার বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে গরম অনুভূত হচ্ছে বেশি। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ধানসহ আমাদের কৃষি এই তাপমাত্রার সাথে সহনশীল নয়। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষিতে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক ঘটনা ঘটছে। আগের চেয়ে গরমের ব্যাপ্তি বেড়েছে। গত বছর আমরা দেখেছি, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি হয়নি। ভূগর্ভস্থ পানি পেতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। তবে সবকিছুর জন্য একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী নয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এখন সবার পকেটে মোবাইলে ওয়েদারের অ্যাপ আছে। মোবাইলে দেখা যাচ্ছে, তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি, আমাদের আবহাওয়া অধিদফতর বলছে ৩৮ ডিগ্রি। চার ডিগ্রির তফাৎ! তারা মাপছে আগারগাঁওয়ে সেখানে একরকম গরম, আর আমি মহাখালীতে আছি সেখানে গরম বেশি। তবে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বৈশাখ মাসে এই তাপমাত্রা কিন্তু ৫০০ বছর ধরেই উঠানামা করছে। কোনো বছর একটু বেশি হয়, কোনো বছর এটি কম হয়। এতে খুব বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।’
তীব্র তাপপ্রবাহে গত পাঁচ দিনে দেশজুড়ে হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন ৩৬ জন।
১৯৮১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ৪৩ বছরে এপ্রিল মাসের তাপমাত্রার নিয়ে গবেষণা করেছেন আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘এমন কোনো বছর নেই এপ্রিলে তাপপ্রবাহ হয়নি। ৪৩ বছরে প্রতিবারই এপ্রিলে কমপক্ষে দুই দিন মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ছিল। তাপপ্রবাহের সবচেয়ে কম সময়কাল ছিল দুই দিন এবং দীর্ঘতম সময় ছিল ২৩ দিন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কখনো কখনো তিন সপ্তাহের বেশি এই তাপমাত্রা অব্যাহত ছিল। তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ সর্বোচ্চ সাত দিন স্থায়ী হয়। সাধারণত দুই থেকে চার দিন বেশি স্থায়ী হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে। আমরা যেটা বুঝতে পারি, এখন আবহাওয়া এক ধরনের অনিয়মিত অবস্থায় চলে গেছে। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। আগে আমরা ঋতু ধরে বলতে পারতাম কখন কী হবে? কিন্তু এখন সেটা বলা সম্ভব না। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে না, সারাবিশ্বেই এমন অবস্থা।’
আর এই অবস্থার জন্য নিজেদের দায়ী মানছেন এই ড. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছি। আরেকটা বিষয় হলো শিল্পায়নের আগে যে তাপমাত্রা ছিল, শিল্পায়নের পর তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। ফলে আমরা যে উষ্ণতার দিকে যাচ্ছি, সেটা তো আগে থেকেই ধারণা করা হয়েছিল। এখন সেটাই হচ্ছে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) হিসাব অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময় প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে।
সংগঠনটির সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘শুধু ঢাকা নয়, এখন জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পুকুর বা জলাধার ভরাট করে পরিকল্পনাহীন ভবন গড়ে উঠছে। নগরগুলোর প্রতিটি ভবন পরিকল্পিত না হলে এবং এলাকাগুলোতে সবুজের ভারসাম্য আনা না হলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।’
অনেকেই বলছেন, তীব্র তাপদাহের কারণে মানুষের কর্মক্ষমতা যেমন কমে যাচ্ছে, কৃষিতেও পড়ছে তার নেতিবাচক প্রভাব।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: কামরুজ্জামান মিলন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘উষ্ণ আবহাওয়ায় ভবিষ্যতে অস্বস্তি আরো বাড়বে। তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির ওপরে টানা তিন দিন থাকলে যে ধানে পরাগায়ন পর্যায়ে ফুল এসেছে, ওই ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চিটা হয়ে যাবে। তবে এ বছর বেশিরভাগ ধানের ওই অবস্থা পার হয়েছে। কিছু কিছু অঞ্চলে যারা দেরিতে চাষ করেছেন, এ অবস্থায় তাদের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গত বছরও এ ক্ষতি হয়েছিল।’
তিনি জানালেন, এই ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২১ সালে। বলেন, ‘ওইবার অনেক কৃষকের ধান পুড়ে গিয়েছিল। আমরা কৃষকদের বলেছি, তাপপ্রবাহের কারণে ধানক্ষেতে বেশি করে পানি ধরে রাখার জন্য। যাতে তাপমাত্রা একটু হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকে। যদিও এতে কৃষকের সেচের খরচ বেড়ে যাবে।’
দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি সেচ প্রকল্প হলো গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প বা জিকে প্রকল্প। কুষ্টিয়াসহ চার জেলার প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দিতে জিকে সেচ প্রকল্প চালু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকদের সেচ খরচ কমার পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ও কমেছিল।
সম্প্রতি সবকয়টি পাম্প নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভরা মৌসুমেও পানি পাননি কৃষকেরা। কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের তিনটি প্রধান পাম্পের মধ্যে দু’টিই নষ্ট। সম্প্রতি তৃতীয় পাম্পটিও অকেজো হয়ে পড়েছে। এমনকি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি চুরি হয়ে গেছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় সেচের পানি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের সবকটি পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন কৃষকেরা।
হিট শকে মাঠের বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। লোডশেডিংয়ের কারণে গ্রামে বিদ্যুৎচালিত সেচ ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে। এ কারণে শেষ মুহূর্তে বোরো ধানের জমিতে পানি দেয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া আম, লিচু, কাঁঠাল, জাম, জামরুলসহ মৌসুমি ফল মুকুলেই ঝরে পড়ছে। মাঠেই রোদের তাপে পুড়ে মরে যাচ্ছে ভুট্টা, কলাসহ নানা ধরনের ফসল। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনাও তেমন নেই। ফলে ফল-ফসলের ক্ষতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ বলতে পারছেন না।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সাবেক (পিকেএসএফ) সভাপতি অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমাদের কৃষি এই ধরনের তাপমাত্রার সাথে অভ্যস্ত নয়। ফলে কৃষিতে ক্ষতি তো হবেই। যেমন ধরেন এই তাপপ্রবাহের কারণে আমের বেশ ক্ষতি হবে। অনেক আমের গুটি ঝড়ে গেছে। ধানে চিটা পড়ে যাচ্ছে।’
এই অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে। কতটুকু প্রভাব পড়বে, সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, রিকশাচালক ও দিনমজুরেরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। হিট স্ট্রোকসহ নানা ধরনের প্রাণঘাতী সমস্যা হচ্ছে তাদের। তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘বর্তমানে প্রচণ্ড গরমে ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বর ও নিউমোনিয়ার রোগী বেশি আসছে। গরমে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এখন নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাই বেশি।
সূত্র : ডয়চে ভেলে
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা