বাংলাদেশের নদীগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ মে ২০২৩, ১১:৪০
যদিও হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীর পানির স্রোতে বয়ে আসা পলি জমে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু এই নদীর দেশের নদীগুলোই আজ মৃতপ্রায়।
উজানের পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে মারা গেছে দেশের অধিকাংশ ছোট নদী। অনেক নদী আজ আর মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। আর যেসব নদীতে পানি প্রবাহ রয়েছে সেগুলোও দখল ও দূষণের শিকার হয়ে ধুঁকছে। নদীর দেশে নদীই আজ বিপন্ন।
সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও স্বাধীনতার পরে শতাধিক নদী হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে নদ-নদীর সংখ্যা কত কমল, সেই সংক্রান্ত একটি সমীক্ষা ২০১০ সালে প্রকাশ করে বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরাম।
ওই গবেষণায় বলা হয়, দেশের ১১৫টি নদী হয় মারা গেছে নয়ত হয়ে গেছে মৃতপ্রায়।
কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও ক্ষমতাশালী লোকজনের লোভের কারণে যেসব নদী অবশিষ্ট আছে সেগুলোও ধুঁকছে। কিছু কিছু নদী কল-কারখানার বর্জ্যে দূষিত হতে হতে পরিণত হয়েছে কলো রঙের ক্যামিকেল বর্জ্যের প্রবাহে।
রিভার্স অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা এ বছরের আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে (১৪ মার্চ) নদী দূষণ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র দু’দশক আগেও নদী দূষণ ছিল একান্তই ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় শহর কেন্দ্রিক সমস্যা। কিন্তু এ দূষণের বিস্তার ঘটেছে, এমনকি গ্রাম পর্যায়েও।
সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী এখন আর ঢাকার আশপাশের কোনো নদী নয় বরং সিলেট বিভাগের সুতাং নদী কারখানার বিষে জর্জরিত সবচেয়ে দূষিত নদীর তকমা পেয়েছে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাছাই করে ঢাকা, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগে সংস্থাটি ৫৬ নদীতে বছরব্যাপী সমীক্ষা চালায় আরডিআরসি।
এসব ৫৬টি নদীর ১৯টি ঢাকা বিভাগে, সাতটি খুলনার, সিলেটের পাঁচটি, চট্টগ্রামের আটটি, রাজশাহীর দুটি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের চারটি নদী রয়েছে। জরিপকৃত সবগুলো নদীই হয় শিল্প কারখানা নয়তো গৃহস্থালি বর্জ্য বা প্লাস্টিক দূষণের শিকার।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫৬টির মধ্যে ২৫টিরই পাঁচ মিলিগ্রামেরও কম। তার মানে সেখানে মাছ বা জলজ প্রাণী টিকে থাকার মতো আদর্শ পরিবেশ নাই।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের নদীগুলো একাধারে শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালি বর্জ্যের শিকার হয়ে বহু বছর ধরে মৃত। নদীর পানির রঙ শুষ্ক মৌসুমে পিচের মতো কালো রঙ ধারণ করে।
এর মধ্যে বুড়িগংগা, টঙ্গী খাল (নদী), শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাড়িধোয়া, সিলেটের সুতাং ও বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে এক মিলিগ্রামেরও কম।
ঢাকার বালু ও তুরাগ নদীতে অক্সিজেনের পরিমাণ অক্সিজেনের মাত্রা দুই মিলিগ্রামের কম। তার মানে এ সবগুলো নদীর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে।
বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলের জরিপকৃত রামনাবাদ, আন্ধারমানিক, খাপরা, ভাংগা ও বলেশ্বর নদীতে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক থাকলেও সেখানে রয়েছে মারাত্মক প্লাস্টিক দূষণ।
৫৬টি নদীর মধ্যে ১৬টি গৃহবর্জ্য ও প্লাস্টিক বর্জ্যের দূষণের শিকার।
এ সংস্থারই আর একটি জরিপে দেখা গেছে, শুধুমাত্র তুরাগ নদীর দূষণের কারণে নদীর দু’পাড়ের ৩৩টি জেলে পল্লীর লোকেরা জীবিকা হারিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, এসব জেলে পল্লীর লোকেরা বর্ষার তিন-চার মাস ছাড়া তুরাগে মাছ ধরতে পারে না। দূষণের শিকার হয়ে নদীপাড়ের জেলে পল্লীর লোকজন খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
খোদ ঢাকা শহরের বসিলা বা সাভারের জেলে পল্লীর অধিকাংশ লোকই এখন তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এখন স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন আবার কেউ কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন।
সাভারের বটতলার জেলেপাড়ায় কথা হলো রনজিত রাজবংশীর (৫৫) সাথে।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে তিনি শীতলক্ষ্যা নদীতে মাছ ধরেন। কিন্তু এখন ওই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বিশেষ করে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো সাভারে স্থানান্তর হওয়ার পর নদী পুরোপুরি দূষিত হয়ে পড়েছে।
তার ছেলে স্থানীয় বাজারে মাছের ব্যবসা করেন। আর তিনি গত কয়েক বছর ধরে বেকার জীবন-যাপন করছেন।
রঞ্জিত আরো বলেন, আমরা মাছ ধরা ছাড়া কিছু শিখি নাই। তাই অন্য কাজও এই বয়সে করতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানাগুলো এবং ট্যানারি প্রতিদিনই নদীতে তরল বর্জ্য ফেলছে। ফলে নদীর পানি পরিণত হয়েছে ঘন কালো তরল বর্জ্যে।
নদী রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকার থাকার পরও কেন নদীগুলোকে রক্ষা করা যাচ্ছে না জিজ্ঞাসা করলে আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সরকার তার সমস্ত ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা করছে নদীর কথা মাথায় রেখে। এজন্যই সরকার ডেলটা প্লান ২১০০ প্রণয়ন করেছে। ২০১৩ সালে যে বাংলাদেশ পানি আইন করেছে সেটাতেও নদীরক্ষার অঙ্গীকার স্পষ্ট আছে। কিন্তু সমস্যা বাস্তবায়নে। সরকারের এই স্বদিচ্ছা কোনোভাবে স্থানীয় পর্যায়ে যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, তারা সরকারের এই প্রায়োরিটির জায়গাটা জরুরিভাবে বাস্তবায়ন করছে না।
যদিও হাইকোর্ট ২০০৯ সালে সরকারকে নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে নদীকে জীবন ফিরিয়ে দিতে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ দেন।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে, নদীতে কলকারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, দখলদারদের হাত থেকে নদীর দখলকৃত জায়গা উদ্ধার করে নদীর পাড়ে সীমানা পিলার বসিয়ে দেয়া ছিল অন্যতম।
কিন্তু নির্দেশনার পর ১৪ বছর পার হয়ে গেলেও সরকার এখন পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে একটি নদীও উদ্ধার করে কোনো উদাহরণ তৈরি করতে পারে নাই। নদী দূষণও বন্ধ হয় নাই, বরং সরকারি বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা প্রকারন্তরে দখলদারদের সাহায্য করছেন।
শরিফ জামিল বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এবং ইন্টারন্যাশনাল রিভারকিপার, বাংলাদেশ প্রতিনিধি এবং নদী রক্ষা আন্দোলনের সাথে বহু বছর ধরে জড়িত। নদী নিয়ে সরকারের অঙ্গীকার এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও কেন কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আসলে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বা কর্মকর্তারা নদী ধংসের জন্য কাজ করেছে, তাদেরকেই নদী রক্ষার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই নদীগুলো রক্ষা পাচ্ছে না।
যেসব সরকারি কর্মকর্তারা নদীর জায়গা দখলে দখলদারের সহায়তা করেছে, তাদেরকেই নদীর সীমানা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে তারা স্বভাবতই দখলদারের দখল করা জায়গা বাদ দিয়ে নদীর সীমানা নির্ধারণ করছেন।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তাও তাদের এই সব কর্মকাণ্ডের জন্য শাস্তি পায় নাই। এমন কী যারা দখল দূষণ করছে তাদেরকেও কোনো রকম জবাবদিহিতার আওতায় আনা হচ্ছে না।’
শরিফ জামিল আরো বলেন, ‘আইনের বাস্তবায়ন না হওয়াই হচ্ছে নদী রক্ষার প্রধান বাধা।’
নদী রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সরকার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নামে একটি কমিশন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু ওই কমিশনও কোনো কার্যকারী ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
নদী রক্ষা কমিশন তাদের ২০১৯ সালে বার্ষিক প্রতিবেদনে সারাদেশে মোট ৬৬ হাজার দখলদার চিহ্নিত করে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। কিন্তু গত তিন বছরে নদী রক্ষা কমিশন নতুন কোনো বার্ষিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করছে না।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা