কীভাবে হয় করোনাভাইরাসের মিউটেশন, ধরা পড়লো কীভাবে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ২৩:০২
মহামারির শুরুর সময়টা থেকেই বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের জেনেটিক গঠনে কোন পরিবর্তন আসে কিনা - তার ওপর নজর রাখছিলেন।
সব ভাইরাসেরই মিউটেশন হয়, অর্থাৎ এটা নিজেকে নিজে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে থাকে। সাধারণত দেখা যায় - প্রতি এক মাস সময়কালে একটি বা দুটি পরিবর্তন হয়ে থাকে।
অনেক সময়ই এই মিউটেশনগুলো ভাইরাসের আচরণের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলে না, বা ফেললেও তা হয় খুবই নগণ্য।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ড. লুসি ভ্যান ডর্প হচ্ছেন মানবদেহে রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিবর্তনের ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ।
"বেশির ভাগ সময়ই এগুলো গুরুত্বহীন, এবং খুব বিরল দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া এটা ক্ষতিকর কিছুও নয়। সার্স-কোভ-টু'র জেনোমে আমরা যে মিউটেশনগুলো দেখেছি তার বেশির ভাগই ভাইরাসটির আচরণে কোন পরিবর্তন আনে না।"
গত বছর ডিসেম্বরে চীনে প্রথম যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়েছিল - সেটা এখন পর্যন্ত অন্তত ১৭ বার পরিবর্তিত হয়েছে।
টিকে থাকার জন্যই সবসময় নিজেকে বদলাতে থাকে করোনাভাইরাস
কিন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে ভাইরাসটি এমন দু-একটি মিউটেশন ঘটিয়ে ফেলে যা তাদের টিকে থাকা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এরকম মিউটেশন বহনকারী ভাইরাস তখন প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে - যদি মহামারি ছড়ানোর পূর্বশর্তগুলো অনুকুল থাকে" বলছিলেন ড. ভ্যান ডর্প।
যুক্তরাজ্য থেকে ছড়ানো করোনাভাইরাসের যে মিউটেশনটি নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় হৈচৈ চলছে তার নাম B.1.1.7 অথবা VUI-202012/01 - এবং এটির সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা অন্য প্রজাতিগুলোর চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। এটি এখন ছড়াচ্ছে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে।
বিশেষ করে যা দুশ্চিন্তার কারণ তা হলো - করোনাভাইরাসের গায়ে যে কাঁটার মত স্পাইকগুলো থাকে সেগুলোর প্রোটিনে এমন কিছু পরিবর্তন এ মিউটেশনের ফলে হচ্ছে যাতে এটা আরো সহজে মানুষের দেহকোষে ঢুকে পড়তে পারছে।
এই নতুন ধরনের করোনাভাইরাসে ১৪টি মিউটেশন আছে প্রোটিন তৈরির উপাদান যে এ্যামিনো এসিড - তাতে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসছে এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হয়তো ভাইরাসটির দ্রুত ছড়াতে পারার ক্ষমতার ওপর এর কোন কোনোটি প্রভাব ফেলছে।
এসব মিউটেশনের কথা বৈজ্ঞানিকদের আগেও জানা ছিল, কিন্তু এত বিশদভাবে জানা ছিল না।
. স্পাইক প্রোটিনে এনফাইভ জিরো ওয়ান নামে একটি মিউটেশনের কথা আগে জানা গিয়েছিল কিন্তু এখন এটির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন হয়ে থাকতে পারে।
. বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পি সিক্সএইট ওয়ান এইচ নামে আরেকটি মিউটেশন জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
. কিছু জেনেটিক সংকেত এ মিউটেশনের সময় বাদ পড়েছে - যা এর আগে নেদারল্যান্ডে মিংক নামে এক ধরণের লোমশ প্রাণীর মধ্যে দেখা গিয়েছিল।
এই প্রাণীর লোমশ চামড়া দিয়ে দামী কোট তৈরি হয়, এবং এজন্য ফার্মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হয় এই মিংক।
দুর্বল ইমিউনিটিসম্পন্ন মানুষের দেহেও এ মিউটেশন হয়ে থাকতে পারে
তা ছাড়া দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের দেহেও এটা পাওয়া গিয়েছিল - যেখানে ভাইরাসটি কোন রকম লক্ষণ দেখা দেবার আগে কয়েকমাস ধরে অবস্থান করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, নতুন ভ্যারিয়েন্টটি কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার একটা ধারণা হয়তো এখান থেকে পাওয়া যেতে পারে।
হয়তো দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন রোগীদের দেহে ভাইরাসটি কয়েক মাস ধরে নিরাপদে অবস্থান করেছে এবং সেখানেই এ মিউটেশনগুলো ঘটেছে।
কগ-ইউকের বিজ্ঞানী এবং গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড রবার্টসন বলছেন, "এখন আমরা যেভাবে চিন্তা করছি তা হলো - দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের প্রেক্ষাপটেই এতগুলো মিউটেশনের মাধ্যমে বিবর্তনগুলো হয়েছে।"
মিংকের সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে?
"মিংক বা অন্য কোন প্রাণীর এতে জড়িত থাকার কোন প্রমাণ নেই, তবে এ সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে না দেয়াটাই হয়তো উচিত হবে" - বলেন অধ্যাপক রবার্টসন।
কীভাবে চিহ্নিত হলো এই নতুন ধরণের ভাইরাস
করোনাভাইরাসের নতুন এই প্রকারটি চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে কিন্ত এমন হতেই পারে যে তার অনেক আগে থেকেই এটি যুক্তরাজ্যের বাইরে কোথাও ছড়াচ্ছিল।
হয়তো এটির উৎপত্তিও যুক্তরাজ্যের বাইরে - এ সম্ভাবনাও আছে।
তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি চিহ্নিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে কারণ সেখানে করোনাভাইরাসের ওপর নজরদারির যে বৈজ্ঞানিক অবকাঠামো আছে তা অত্যন্ত শক্তিশালী।
এর নাম হচ্ছে কগ-ইউকে বা "কোভিড-১৯ জেনোমিক্স কনসোর্টিয়াম" - এতে দেড় লক্ষেরও বেশি সার্স-কোভ-টু ভাইরাসের নমুনার জেনেটিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা হচ্ছে । সারা পৃথিবীতে এ ভাইরাসের যে পরিমাণ জেনেটিক সিকোয়েন্স সংরক্ষিত আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি আছে এখানে।
এ কারণেই করোনাভাইরাসের নতুন কোন মিউটেশন হলে এর মধ্যে যে ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো হয় - সেগুলো এই কগ-ইউকের বিজ্ঞানীদের চোখে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি।
এ বছর ফেব্রুয়ারি- মার্চ মাসে যখন যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল - তখন এই বিজ্ঞানীরাই দেখতে পেয়েছিলেন যে ভাইরাসটি ব্রিটেনে আসছে মূলত ইউরোপ থেকে - এর আদি উৎপত্তিস্থল চীন থেকে নয়।
করোনাভাইরাসের বিস্তার কীভাবে ঘটছে তা বুঝতে হলে এই গোয়েন্দাগিরি খুবই জরুরি।
আর সে কারণেই যেসব দেশ করোনাভাইরাসের জেনোমিক সিকোয়েন্সিং করছে সেসব দেশেই এর নতুন কোন মিউটেশন হলে তা ধরা পড়ছে - যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস।
এর মধ্যেই বিভিন্ন দেশে পৌঁছে গেছে এই নবতম করোনাভাইরাস
যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ নয় - যেখানে করোনাভাইরাসের এই নতুন রূপ দেখা গেছে।
ইউরোপের ইতালি, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডসে ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে এটির অস্তিত্ব। পাওয়া গেছে অস্ট্রেলিয়াতেও।
তা ছাড়া যুক্তরাজ্যে যেহেতু সেপ্টেম্বর থেকেই এই নতুন মিউটেশনটি চিহ্নিত হয়েছিল তাই মানুষের বিভিন্ন দেশে যাতায়াতের সূত্রে হয়তো এর মধ্যেই এটি আরো কিছু দেশে পৌছে গেছে - তবে এখনো তা চিহ্নিত হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকাতেও পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের একটি নতুন রূপ - যা হয়তো হুবহু একই রকম নয়, তবে প্রায় কাছাকাছি।
দক্ষিণ আফ্রিকায় তরুণদের মধ্যে ছড়াচ্ছে একটি মিউটেশন
দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিলে করোনাভাইরাসের এক নতুন সংস্করণের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে।
এটির নাম ফাইভ জিরো ওয়ান ভি-টু (501.V2) এবং এটি চিহ্নিত করে কোয়াজুলু-নাটাল রিসার্চ ইনোভেশন এ্যান্ড সিকোয়েন্সিং প্ল্যাটফর্ম বা ক্রিস্প নামে এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি দল।
এই ভাইরাস ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক মাত্রায় ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে আগেকার তুলনায় এই নতুন রূপের করোনাভাইরাসটি তরুণ জনগোষ্ঠীকে বেশি করে সংক্রমিত করছে।
বলা হচ্ছে, এটির সাথে যুক্তরাজ্যে দেখা দেয়া মিউটেশনটির বেশ কিছু মিল আছে - তবে হুবহু এক রকম নয় ।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ফাইভ জিরো ওয়ান ভি-টু এখন করোনাভাইরাসের প্রধান ভ্যারিয়েন্টে পরিণত হয়েছে। ব্রিটেনের দক্ষিণে লন্ডন ও এসেক্স কাউন্টিতে এই নতুন ধরণের করোনাভাইরাস আগেরগুলোকে হটিয়ে দিয়েছে।
এগুলো হয়তো আগের চাইতে বেশি মাত্রায় ছড়াচ্ছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছুই স্পষ্ট নয়।
একটা বড় প্রশ্ন টিকার কার্যকারিতা
তবে চীনের গবেষকরা জানুয়ারি মাসে প্রখম করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স প্রকাশ করার পর থেকে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপকহারে এসংক্রান্ত তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে।
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে আড়াই লক্ষেরও বেশি সার্স-কোভ-টু জেনোম সিকোয়েন্স তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা।
এর ফলেই যুক্তরাজ্যে ছড়ানো মিউটেশনটি এত দ্রুতগতিতে "উদ্বেগের কারণ" হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
প্রধান প্রশ্ন এখনো এটাই: তা হলো এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত করোনাভাইরাসের টিকাগুলোর কার্যকারিতার ওপর এই নতুন ধরণের করোনাভাইরাস মিউটেশনগুলোর কোন প্রভাব পড়বে কিনা।
বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞই বলছেন, নতুন মিউটেশনের ফলে টিকার কার্যকারিতা কমে যাবে এমন কোন সম্ভাবনা - অন্তত: স্বল্পমেয়াদে এখনো নেই।
তবে ড. ভ্যান ডর্প বলছেন, আগামী দিনগুলোতে বিজ্ঞানীদের কাছে এ প্রশ্নটি আরো বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা