২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাদল দিনের প্রথম কদমফুল

কদমফুল - সংগৃহীত

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। বহু যুগের ওপার থেকে ভেসে আসা স্মৃতি-সৌরভ। যেন গান হয়ে ভেসে ওঠে : বাদল দিনের প্রথম কদমফুল।
বড় বড় সবুজ পাতার ফাঁকে একেকটি কদমফুল ঝুলে থাকে। মূল বলটা হলুদ সোনালি রঙের। উপরিভাগে রয়েছে সাদা রঙের একটা প্রলেপ। বলে রাখা ভালো, আমরা যে গোল আকারের কদম ফুল দেখি সেটি কিন্তু একটিমাত্র ফুল নয়। অজস্র ফুলের সমারোহ। এর ভেতরের মাংসলপিণ্ড থেকে হলুদ রঙের নলাকৃতির হাজার হাজার ফুল বেরিয়ে এসে বলটাকে স্পঞ্জ বানিয়ে রাখে। ওপরের সাদার প্রলেপগুলো অজস্র ফুলের পরাগকেশ। বলতে পারেন, হাজার ফুলের সমন্বয়ে এটি একটি ফুল। কদমফুলের ঘ্রাণ তীব্র নয়। তবে চার পাশ মদির করে রাখতে পারে। বড় নষ্টলজিক সেই ঘ্রাণ। যে কাউকেই মোহময় করে তুলতে পারে। 

কদমগাছের পাতা বেশি হলেও পাতার ফাঁকে উজ্জ্বল আকর্ষণীয় কদমফুল দূর থেকে চোখে পড়ে। কদমফুলকে বলা হয় বর্ষার দূত। এর কারণ, কদমফুল মূলত বর্ষার ফুল হলেও ফোটা শুরু করে জ্যৈষ্ঠের শেষ দিক থেকেই। কদম ছাড়া আমাদের বর্ষা বেমানান। অসম্পূর্ণ। আষাঢ় মাসেই এ ফুলের সমারোহ হয় বেশি। কদম ছাড়া আষাঢ় যেন কল্পনাই করা যায় না। কদম না ফুটলে যেন বৃষ্টি ঝরে না। 
কদম নামটি সংস্কৃত কদম্বের অপভ্রংশ। এর অর্থ ‘যা বিরহীকে দুঃখী করে’। কদমফুলের নজরকাড়া সৌন্দর্য এবং এর সৌরভ যুগে যুগে বাঙালিকে মুগ্ধ করেছে। এই ফুল পথিককে উদাস করে। গ্রাম্য বালিকাকে চঞ্চল করে তোলে। 
এ কদমফুল নারী প্রেম কতটা তীব্র হতে পারে বাংলা সাহিত্যে তার বহু নিদর্শন রয়েছে। প্রসঙ্গত, প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেনÑ যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো,/ চলে এসো এক বরষায়.../ 
যদিও তখন আকাশ থাকবে বৈরী/ কদমগুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি/ 
...কদমগুচ্ছ খোঁপায় জড়ায়ে দিয়ে/ জলভরা মাঠে নাচিব তোমায় নিয়ে/
তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়... ইত্যাদি।

কৃষ্ণও রাধার প্রেমে বিকুলি। মধ্যযুগের পুরো বৈষ্ণব সাহিত্য রাধা-কৃষ্ণের বিরহ বেদনা মোহিত হয়ে আছে কদমের সুরভিতে। 
আজো লোকসঙ্গীতে, গাঁথায় অত্যন্ত জনপ্রিয় এই আখ্যান। 
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কদমফুল নিয়ে অসংখ্য গান কবিতা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন ‘কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ় মেঘের ছায়া খেলে’। কদমের আরেকটি নাম নীপ। কবি লিখেছেন ‘ব্যথিয়া উঠে নীপের বন পুলক ভরা ফুলে’। ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে...’। 

কদম আমাদের নিজস্ব গাছ। তবে ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন ও মালয় এর আদি নিবাস। কদমের বৈজ্ঞানিক নাম অহঃযড়পবঢ়যধষঁংরহফরপঁং। পরিবার জঁনরধপবধব। দ্বিজেন শর্মা তার শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে কদমকে বলেছেন, ‘বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর অন্যতম।’ গাছ দীর্ঘাকৃতির। ডালপালা বিস্তৃত। মাটির সাথে সমান্তরাল। পাতা বেশ বড় বড়। ডিম্বাকৃতির। গাঢ় সবুজ।

গাছের কাণ্ড সরল, উন্নত, ধূসর থেকে প্রায় কালো এবং বহু ফাটলে রূক্ষ, কর্কশ। শীতে সব পাতা ঝরে যায়। বসন্তে কচিপাতা আসে উচ্ছ্বাস নিয়ে।
প্রস্ফুটন মওসুমে ছোট ছোট ডালের আগায় একক কলি আসে গোল হয়ে। বর্ষাকালেই মূলত ফুল ফোটে। তবে জৈষ্ঠ্যের শেষ দিকে অনেক গাছে ফুল ফোটা শুরু হয়। গাছের ছাল, কাণ্ড, পাতা, ফল, ফুল, ফুলের রেণু ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

বর্ণে গন্ধে সৌন্দর্যে কদম এ দেশের রূপসী তরুর অন্যতম হলেও অবহেলা-অনাদরে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এ গাছ। এক সময় তো কদমগাছ ছাড়া কোনো গ্রাম আছে এটা কল্পনাই করা যেত না। এখন দশ গ্রাম ঘুরেও কদমের দেখা পাওয়া যায় না। বলা যায় না অবহেলায় একদিন হয়তো হারিয়ে যাবে এই গাছটা। তখন হয়তো কদম ছাড়াই বর্ষা উদযাপন করতে হবে আমাদের। তাই প্রয়োজন সচেতনতা। প্রকৃতির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে অন্য গাছের পাশাপাশি কদমগাছ রোপণ করা প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement