২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বিমানবন্দরে ২১ হাজার কোটি টাকার থার্ড টার্মিনালে যা আছে

বিমানবন্দরে ২১ হাজার কোটি টাকার থার্ড টার্মিনালে যা আছে - ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার প্রত্যাশা ঢাকা ও কক্সবাজারের দুটি বিমানবন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের অ্যাভিয়েশন হাবে পরিণত হবে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালটি প্রধানমন্ত্রী শনিবার ‘সফট ওপেনিং’-এর পর টার্মিনাল ব্যবহার করে বিমান চলাচল শুরু হলেও এর পুরোপুরি ব্যবহার সম্ভব হবে আগামী বছরের শেষ দিকে আনুষঙ্গিক আরো কিছু কাজ শেষ হওয়ার পর।

বিশেষ করে টার্মিনাল কার্যক্রমে ব্যবহৃত উপকরণের ক্যালিব্রেশন ও প্রস্তুতির কারণে টার্মিনালটি পুরোপুরি ব্যবহারে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান।

জাপানের আর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত এই টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজও জাপানকে দেয়া হবে বলে মফিদুর রহমান জানিয়েছেন। এ গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ এত দিন বিমান বাংলাদেশ করতো।

কর্তৃপক্ষ বলছে, থার্ড টার্মিনাল হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নতুন এই টার্মিনালের মাধ্যমেই মূলত বাংলাদেশ পুরাতন ধারা বিমানবন্দর পরিষেবা থেকে বেরিয়ে আধুনিক বিমানবন্দর যুগে প্রবেশ করলো।

নতুন টার্মিনাল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন এই টার্মিনালের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর এবং এরপর করোনা মহামারির সময়েও বিশেষ ব্যবস্থায় এ প্রকল্পের কাজ চলমান রাখা হয়েছিল।

২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায় জাপানের মিৎসুবিশি, ফুজিটা ও দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ করেছে এবং এ টার্মিনালকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও মেট্রোরেলের একটি রুটের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

এছাড়া ফ্রান্সের সহায়তায় আধুনিক প্রযুক্তির রাডারসহ অন্য প্রয়োজনীয় আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংযোজন করা হয়েছে এ টার্মিনালে। একটি টানেলের মাধ্যমে এই টার্মিনাল থেকে সরাসরি হজ ক্যাম্প ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সাথে যাতায়াতের ব্যবস্থার কাজ এখনো চলমান রয়েছে।

নতুন নির্মিত টার্মিনালটি সম্পর্কে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিচে দেয়া হলো :

  • টার্মিনালটির যাত্রী ক্যাপাসিটি হবে এক কোটি ৬০ লাখ। এখন যে দুটি টার্মিনালে আছে তার সক্ষমতা আছে ৮০ লাখ যাত্রী। ফলে তৃতীয় টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে বছরে দুই কোটি ৪০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
  • টার্মিনালটির ফ্লোর আয়তন দুই লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার। এর আগের দুটি টার্মিনালের মোট ফ্লোর স্পেস ছিল এক লাখ বর্গমিটার।
  • নতুন টার্মিনালে মোট বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে ২৬টি, যেখানে আগের দুটি টার্মিনালে মোট ব্রিজ ছিল আটটি। একই সাথে নতুন টার্মিনালে মোট ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্কিং করা যাবে। আগের দুটিতে রাখা যেত ২৯টি উড়োজাহাজ।
  • আগে লাগেজ কনভেয়ার বেল্ট ছিল দুই টার্মিনাল মিলিয়ে আটটি। আর তৃতীয় টার্মিনালে এ ধরনের বেল্ট আছে ১৬টি।
  • আগের দুটি টার্মিনালে মোট চেক ইন কাউন্টার ছিল ৬২টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ছিল ১০৭টি। তৃতীয় টার্মিনালে আরো যুক্ত হয়েছে চেক ইন কাউন্টার ১১৫টি আর ইমিগ্রেশন কাউন্টার ১২৮টি।

মুভি লাউঞ্জ ও কিডস জোনসহ আরো যা আছে :

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন টার্মিনালে এয়ারলাইন্স লাউঞ্জ, ডে-রুম, মুভি লাউঞ্জ, শিশুদের জন্য প্লে-জোন এবং ফুড কোর্ট সংযোজন করা হয়েছে। এগুলো যাত্রীদের বিমানবন্দরে অবস্থান ও অপেক্ষার সময়টিকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলছেন, ঠিকমতো পরিচালনা করতে পারলে আগামী পাঁচ-সাত বছর বাড়তি যাত্রীদের জন্য সুন্দর সেবা দিতে তৃতীয় টার্মিনাল সক্ষম হবে।

তিনি বলেন, ‘যাত্রীরা এখন বিমানবন্দরে এসে সুপরিসর জায়গা ও ভালো পরিবেশ পাবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠান এয়ারপোর্টে কাজ করবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে সেবার মান বাড়ানোর জন্য।’

তার মতে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, দুবাই ও নারিতাসহ সব জায়গায় এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আলাদা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এটি করছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, যারা মূলত রেগুলেটরি সংস্থা।

ঢাকা বিমানবন্দরটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। ১৯৬৪ সালের ডিজাইনে আশির দশকে শেষ করা এই বিমানবন্দরের আগের দুটি টার্মিনাল বহু বছর ধরেই যাত্রী ও কার্গো সামলাতে পারছিল না বলে যাত্রী ও কার্গো পরিবহনে দুর্ভোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।

ওয়াহিদুল আলমের মতে, বিমানবন্দরটির নতুন একটি টার্মিনাল আরো আগেই প্রয়োজন ছিল।

তিনি বলেন, ‘তাছাড়া বৈশ্বিক কারণে এয়ারপোর্ট নিরাপত্তা এখন অন্য স্তরে চলে গেছে কিন্তু তার সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো অবকাঠামো পুরনো টার্মিনালে নেই এবং সংযোজনেরও সুযোগ নেই। এ কারণেও নতুন টার্মিনাল দরকার ছিল। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করবে যে ২৫-৩০টি সংস্থা এয়ারপোর্টে কাজ করে তারা দক্ষতার সাথে সমন্বয় করতে পারছে কি-না তার ওপর।’

একই ধরনের মতামত দিয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি একটি এয়ারওয়েজের একজন পরিচালক এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, নতুন টার্মিনালের সফলতা নির্ভর করবে কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, সিকিউরিটি ও সিভিল এভিয়েশন যাত্রী অধিকার ক্ষুণ্ন না করে প্রয়োজনীয় সব পরিষেবা দ্রুত দিতে পারে কি-না তার ওপর।

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু মনে রাখতে হবে মেশিন থাকলেই হবে না, মেশিনের পেছনে যে লোকগুলো কাজ করবেন তারা এয়ারপোর্টে ইউনিক কাজের জন্য যোগ্য কি-না, সেই দক্ষতা আছে কি-না। তা না হলে যাত্রীদের দুর্গতি কমবে বলে মনে হয় না।’

নজরুল ইসলামের মতে, যাত্রী অধিকার ক্ষুণ্ন করার চর্চা অব্যাহত থাকলে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো কম উৎসাহী হবে এবং তেমনটি হলে তৃতীয় টার্মিনালের প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া কঠিন হবে।

ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার চ্যালেঞ্জ
পাসপোর্ট, টিকিট কিংবা বোর্ডিং কার্ড- এসব কিছু ছাড়াই ১২ বছরের একটি শিশু শাহজালাল বিমানবন্দরের সবধরনের নিরাপত্তা এড়িয়ে কুয়েতগামী একটি ফ্লাইটে বসতে সক্ষম হয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল গত ১২ সেপ্টেম্বর। শুধু এমন দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নয়, বরং জরাজীর্ণ অবকাঠামো, অপ্রতুল পার্কিং, যাত্রীদের প্রতি অসদাচরণ ও দুর্নীতি কিংবা চোরাচালানের জন্য বরাবরই খবর হয়ে আসছে ঢাকার এই বিমানবন্দরটি।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থার মূল্যায়নেও বারবার উঠে এসেছে যাত্রী সেবার মান নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। আর গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংসহ যাত্রীদের লাগেজ নিয়ে ছিল ভোগান্তি ছিল নিয়মিত ঘটনা।

বিমানবন্দর ও উড়োজাহাজ সংস্থা নিয়ে রেটিং সংস্থা স্কাইট্র্যাক্সের মূল্যায়ন অনুযায়ী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির মান সাধারণ এভারেজেরও নিচে এবং তাদের হিসাবে ১০ পয়েন্টের মধ্যে ৪ পেয়েছিল এ বন্দরটি।

এমন-কি যাত্রীদের সাথে বন্দরটির কর্মচারীদের ব্যবহার খুবই নিম্নমানের। বিশেষ করে সুযোগ পেলে নিরীহ যাত্রীদের হয়রানি ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

আগে দুটি টার্মিনালের জন্য কার পার্কিং সুবিধা ছিল ৩০০। কিন্তু নতুন টার্মিনালে আলাদা পার্কিং লট করা হয়েছে যেখানে এক সাথে এক হাজার ২৩০টি গাড়ি পার্ক করা যাবে।

কর্তৃপক্ষ বলছে নতুন অবকাঠামোর সাথে আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটনায় এখন থেকে নতুন থেকে যাত্রীসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করেন তারা।

পাশাপাশি গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং অর্থাৎ লাগেজ ব্যবস্থাপনায় জাপান দায়িত্ব নেয়ার পর বিমানবন্দরটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা সত্যিকার অর্থেই স্মার্ট হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ।

এর চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান আগেই জানিয়েছেন, তৃতীয় টার্মিনালে এমন কিছু বিষয় সংযোজিত হয়েছে যা আগের দুটি টার্মিনালে ছিল না।

তবে ওয়াহিদুল আলম বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল হওয়ার পর এয়ারপোর্টের জন্য এখন আলাদা সমন্বিত কর্তৃপক্ষ গঠন করা উচিত।

তিনি বলেন, ‘সিভিল এভিয়েশন কাজ টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট হতে পারে না। এর জন্য আলাদা সমন্বিত কর্তৃপক্ষ না হলে শুধুমাত্র একটি আধুনিক টার্মিনাল তৈরি করে বিমানবন্দরের সঙ্কট দূর করা কঠিন হবে।’

আবার কাস্টমস, ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি লোকজনের আচরণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে যাত্রীদের মধ্যে।

এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, এসব সংস্থাগুলোর লোকজন বিমানবন্দরে কাজের জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষিত নন।

তিনি বলেন, ‘ফলে যাত্রীদের প্রচুর ভোগান্তি হয়। যাত্রীর যে অধিকার একটি বিমানবন্দরে সে সম্পর্কে অনেকের ধারণাই নেই। আরোও অনেক অভিযোগ তো আছেই। তাই থার্ড টার্মিনালের সুফল নিতে হলে এসব সংস্থার কাজের দৈন্যদশা কাটাতে হবে।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement