৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গুমোট কান্না চেপে সার্কাসে মাত করেন সুমন (ভিডিওসহ)

সুমন - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজধানীর বায়তুল মোকারমের পূর্ব দিকে এরশাদ রোড। একটা জটলা। ভিড়ের মধ্যে ঢুকে দেখা গেল একটা ফাঁকা জায়গায় খালি গায়ে এক যুবক লাফালাফি করছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর বোঝা গেল তিনি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে শারীরিক করসৎ দেখিয়ে আনন্দ দিচ্ছেন। আমিও দেখতে থাকলাম। হঠাৎ মনে হলো ভিডিও করি। তখন অবশ্য তার খেলা দেখানো শেষ পর্যায়। অসাধারণ শারীরিক কসরতে তিনি ইতোমধ্যেই উপস্থিত সবার মন জয় করে নিয়েছে। তার দেখানো কসরৎগুলো যেমন খুব ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি আকর্ষণীয়। অবলীলায় তিনি শূন্যে ডিগবাজি খাচ্ছিলেন, পেছনের দিকে মাথা বাঁকা করে চোখ দিয়ে টাকা উঠাচ্ছেন, বুকের উপর ইট রেখে অন্য একটি ইট দিয়ে তার উপর আঘাত করে ভেঙে ফেলছেন।

সুমনের খেলা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল তাকে যদি প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেয়া যেত, তবে তিনি সারা দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনাম বয়ে আনতে পারতেন।

সুমনের প্রতি আমার আগ্রহ এতটাই বাড়ল যে আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন খেলা শেষ হবে, তার সাথে কথা বলব। খেলা শেষে আমি তাকে ইশারায় ডাক দিলাম। তিনি আমার সামনে এলেন। চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, তিনি ভাবছেন আমি তাকে টাকা দিব। অবশ্য খেলা দেখতে দেখতে সবার সাথে আমিও তাকে ১০ টাকা দিয়েছিলাম। যাই হোক সুমন আমার কাছে এলে নাম জানতে চাইলাম। খুব আস্তে উত্তর দিলেন, ‘সুমন’। তার উত্তরে ক্লান্তির মিশ্রণ ছিল তা বলার অবকাশ রাখে না। আমি তাকে আমার নাম ও পরিচয় দিয়ে তার সাথে কথা বলতে চাইলাম। তিনি কথা বলতে অনাগ্রহ দেখিয়ে বায়তুল মোকারমের অজুখানার দিকে চলে গেলেন। আমিও তার পিছু নিলাম। সেখানে তার পাশের বসে আবার কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম ‘কেমন আছেন?'

তার উত্তর, 'আমার জামাটা ছিইড়া গেছে আপনের একটা পুরাতন জামা আমারে দেবেন?' উত্তরে আমি তাকে একটি শার্ট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানতে চাই আপনাকে কোথায় পাবো? উত্তরে বললেন, “কালকা বিকেলে এইহানেই খেলা দেহামু।' বলেই বাথরুমে চলে গেলেন। আমি অবশ্য হাল ছাড়িনি। সেখানে আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম তিনি সম্ভবত গোসল করে বের হয়েছেন। আমি আবার তার গতিরোধ করে বায়তুল মোকারম মসজিদের পূর্ব গেটের সিঁড়িতে বসার জন্য অনুরোধ করলাম। আমার অনুরোধে সাড়া দিয়ে জানতে চাইলেন, তাকে এক কাপ চা আর একটা রুটি কিনে দিব কিনা? আমি কিনে দিতে সম্মতি প্রকাশ করায় তিনি আমার পাশে এসে বসলেন।

সুমনের সাথে বসে কথা বলতেই বের হয়ে আসে তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা হাজারো কষ্ট। যা শুনে সত্যিই চোখে পানি এসে যায়। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদেছেনও।
পাঠকদের জন্য সুমন ও আমার মধ্যে হওয়া কথাগুলো হুবহু তুলে ধরা হলো
নয়া দিগন্ত- আপনার বাড়ি কোথায়?
সুমন- চট্টগ্রামের কক্সবাজার
নয়া দিগন্ত- আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?
সুমন- কেউ নাই।
নয়া দিগন্ত- কেন বাবা মা কোথায়?
সুমন- নাই।
নয়া দিগন্ত- ভাই বোনরা কোথায় থাকেন?
সুমন- আমি বাপ মায়ের একমাত্র পোলা। আপনি চা-রুটি খাওয়াইবেন না?
নয়া দিগন্ত- হ্যাঁ! আশপাশে দোকান আছে কোথায়?
সুমন- ওই খানে ( হাত দিয়ে দেখালেন)।
নয়া দিগন্ত- চলুন চা খেতে যাই।
চায়ের দোকানে এসে তাকে রুটি নিতে বললাম আর আমি দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। হাতে চা নিয়ে তাকেও ইশারায় ডাকলাম। তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। এবার আমি জানতে চাইলাম আপনার বাবা কবে মারা গেছেন?
সুমন- এই তো ২০-২১ বছর।
নয়া দিগন্ত- কিভাবে মারা গেলেন তিনি?
সুমন- ত্রিবর্ষা খেলা দেহাইতে গিয়া।
নয়া দিগন্ত- ত্রিবর্ষা খেলাটা কি?
সুমন- কান্না করতে করতে বলেন, আমার বাবায় সর্কাস খেলা দেহাইত। বাবায় কক্সবাজার থাইকা চাঁদপুর আইয়া বাড়ি করছিল। একবার খুলনায় সার্কাস দেহাইতে যাইয়া বাবায় বড় বড় ছুরির মধ্যে জাম্প দিছিল। হঠাৎ পা পিছলাইয়া বাবায় ছুরির মধ্যে পইরা কাটা পরে। লগে লগেই মইরা যায়।
নয়া দিগন্ত- তখন আপনার বয়স কত?
সুমন- ৬ বছর।
নয়া দিগন্ত- আপনার মা কবে মারা যান?
সুমন- ১৫ বছর।
নয়া দিগন্ত- চাঁদপুরের বাড়িতে কে থাকেন?
সুমন- নদীতে ভাইঙ্গা গেছে।
নয়া দিগন্ত- আপনার আর কেউ নেই? চাচা, ফুফু, খালা, মামা?
সুমন- এক চাচা ও এক ফুফু আছে।
নয়া দিগন্ত- তারা কোথায় থাকেন?
সুমন- কাকায় আটি বাজার থাহেন আর ফুফু খুলনায়।
নয়া দিগন্ত- তারা কে কী করেন?
সুমন- কাকার একটা চায়ের দোকান আছে আর ফুফু বাদাম বেচে।
নয়া দিগন্ত- তাদের কাছে যান?

সুমন- একদিন কাকার কাছে গেছিলাম। দুধ দিয়া ভাত খাওয়াইছে।
নয়া দিগন্ত- আপনি কি শুধু খেলা দেখিয়ে টাকা আয় করেন?
সুমন- না। দাঁতের মাজন বানাইয়া বেচি।
নয়া দিগন্ত- কিভাবে দাঁতের মাজন বানান!! দাঁতের মাজন বানাতে কী কী ব্যবহার করেন?
সুমন- 'মেডিসিন' দিয়া।
নয়া দিগন্ত- কী 'মেডিসিন' ব্যবহার করেন?

সুমন- ধানের তুষ পুইরা গুড়া কইরা এর লগে ফিটকারির গুড়া মিলাই। পরে আতরের ডিব্বায় ভরি। আতরের ডিব্বা না থাকলে পলিথিন কিননা মোমের আগুন জ্বালাইয়া প্যাকেট করি।
নয়া দিগন্ত- আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
সুমন- আমার ভবিষ্যত ঠিক করা আছে।
নয়া দিগন্ত- কী?
সুমন- এহন যাইয়া এক কেজি ফিটকারি আর আতরের বোতল কিনমু। পরে দাঁতের মাজন বানাইয়া বেচমু আর খেলা দেহাইয়া পেট চালামু।

সুমনের বিষয়ে জানতে চাইলে এরশাদ রোডের দক্ষিণ পাশের চায়ের দোকানে বসা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী শাহজাহান আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, তিনি মাঝে মধ্যে এখানে খেলা দেখান। খুশি হয়ে কেউ টাকা দিলে তা নেন। সুমনের মধ্যে কখনো ব্যতিক্রমধর্মী কিছু লক্ষ্য করেছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহজাহান আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, মাঝে মধ্যে দুপুর বেলা তিনি এখানে একটি গাছের নিচে বসে কানের মধ্যে হাত রেখে একা একা কথা বলেন এবং কান্না করেন। দূর থেকে মনে হয় ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। কিন্তু সামনে গেলে দেখা যায় হাতে কোনো মোবাইল নেই। নিজে নিজেই কথা বলেন, আর কাঁদেন।


আরো সংবাদ



premium cement