২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাকৃবি শিক্ষার্থীদের মুখে ছাত্রলীগের অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা

বাকৃবি শিক্ষার্থীদের মুখে ছাত্রলীগের অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এত দিন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বাকৃবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন। তাদের ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপত্ব্যের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা ভয়ে মুখ খুলতে পারতো না।

কিন্তু গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের হাতে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা তুলে ধরছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক)।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়গুলো সামনে এলে এসব নিষ্ঠুর নির্যাতনের বিষয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সাথে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। শিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিন শিক্ষার্থীর ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো: হাবিবুর রহমান বলেন, ‘২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্লাস শেষে আবাসিক আশরাফুল হক হলে ফেরার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে মোবাইল তল্লাশি করে। তল্লাশির পর ছাত্রদলের লোকজন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে কেন এবং রেটিনা কোচিংয়ের পেজে লাইক দেয়ার কারণ দেখিয়ে শিবিরের সদস্য বলে চিহ্নিত করে। পরে আমাকে সালমান ভাইয়ের রুমে (২৩৬ নং রুম) নিয়ে সেখানে ছাত্রলীগ নেতা সৌরভ, আল মামুন এবং দুর্জয় শারীরিকভাবে আঘাত করতে শুরু করে। এছাড়াও নুহাশ, অন্তর, মিনহাজুল, অন্তর চৌধুরী এসে পাশবিক নির্যাতন করে। পরক্ষণে সালমান কয়েকটি থাপ্পড় দেয়ার পর আজহার রড দিয়ে পিটাইতে থাকে। একপর্যায়ে আমার দুই কানের টিমপ্যানিক মেমব্রেন ফেটে যায়। সাত দিনের মতো তিনি বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কানের অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে আমাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অপারেশন করাতে হয়। আমি ঘটনার সুস্থ বিচার চাই এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফুল হক হলের আরেক আবাসিক শিক্ষার্থী রিফাত বিন শায়েকুজ্জামান বলেন, ‘গেস্টরুমে নির্যাতনের কারণে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বের হওয়ার সময় সিনিয়ররা আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন করে। তামিম মাহমুদ আকাশ আমার বুকে ১০ থেকে ১২ বার লাথি মারে। পরে আমাকে তিন তলায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সাথে প্রচণ্ড মারধর করতে থাকে। আজহার খান ও আকাশের মারধরের একপর্যায়ে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে থেকে রক্ত বের হয়। এরপর শহীদ শামসুল হক হল ছাত্রলীগ নেতা মো: সেন্টু এসে আমাকে সিগারেট ধরাতে বলে। প্রথমে আমি রাজি না হলে পরে সিগারেট ধরাতে গেলে আমাকে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে দেয়। এ সময় সে আমাকে হকিস্টিক দিয়ে মারতে থাকে। প্রচণ্ড জোরে আমার পায়ের হাটুতে মারলে আমি আর মাটি থেকে উঠতে পারিনি।’

কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো: তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে জানতে পারি হলে ছাত্রদল সন্দেহে কয়েকজনকে ধরা হয়েছে এবং তাদেরকে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমাকে গেস্টরুম থেকে ২৩৪ নং রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পর প্রথমেই সালমান মোস্তফার থাপ্পড় খেয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। এরপর আজহার এসে আমার হাটুতে সজোরে রডের আঘাত করে। পরে আমার ফোন চেক করে ছাত্রদলের মিথ্যা ট্যাগ দেয়। কার্যত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম না। শারিরীক নির্যাতনে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, আমি বমি করি। পরে আমাকে দুই ডোজ ওষুধ খাওয়ার পর আবারো আমাকে ১০-১২ জন থাপ্পড় ও রডের বাড়ি দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। আমি হেলথ কেয়ারে চিকিৎসার জন্য গেলে অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসকরা আমাকে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে পাঠায়।’

এ বিষয়ে কথা বললে অন্তর চৌধুরী জানান, ‘আমি তাকে চিনি না। ঘটনাটি আমার জানা নেই।’

সালমান বলেন, ‘আমি এটা সম্পর্কে জানি না। আমি ওই দিন ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তবে কোনো কিছু নিয়ে সে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে।’

নুহাশ বলেন, ‘আমি করোনার পর থেকে রাজনীতিতে আর জড়িত না। বর্তমান কমিটিতে আমার কোনো পদ পদবি নেই। যেখানে রাজনীতিতেই নেই সেখানে শিবির সন্দেহে কাউকে পেটানোর অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

মো: সেন্টু বলেন, ‘ঘটনা ভিত্তিহীন। আমি এমন কোনো ঘটনার সাথে জড়িত ছিলাম না। আমি শামসুল হক হলে ছিলাম, আশরাফুলে এক দিনও থাকিনি। আমি হলে ২০১৮-২১ পর্যন্ত ছিলাম, এর মধ্যে এমন কোনো ঘটনার সাথে জড়িত ছিলাম না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামুন ফোন ধরে কেটে দেন। সৌরভের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, বাকিদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে কার্যত প্রশাসন না থাকায় এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তা জানা সম্ভব হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement