২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমাকে বাঁচাও মা : গুলিবিদ্ধ আবুজরের আকুতি

আবুজর ইসলাম - নয়া দিগন্ত

আবুজর (২৫) পেশায় একজন গাড়িচালক। মালিকের গাড়ি চালিয়ে যে বেতন পেতেন তাই দিয়ে মাকে নিয়ে ছোট্ট সংসার চলতো তার। কোটা কী জানতেনই না তিনি।

জানা গেছে, শুক্রবার (১৯ জুলাই) খালার সাথে দেখা করতে বাসা থেকে বেরিয়ে ছিলেন আবুজর। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বসুন্ধরা এলাকায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন শিশু বয়সে পিতৃহারা আবুজর। ৯ দিন পর মারা যান পেটে গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত আবুজর। মৃত্যুর আগে আবুজর মা সুফিয়া বেগমকে বলেন, মাগো কষ্ট করে হলেও আমাকে বাঁচাও ‘মা’। মৃত্যুর পথযাত্রী ছেলের এই আকুতি মমতাময়ী মায়ের বুকে যেন সেল হয়ে বিঁধে ছিল।

আরো জানা গেছে, ছেলেকে বাঁচাতে ঋণ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন অসহায় মা সুফিয়া বেগম। নিহত গাড়িচালক আবুজর ইসলাম জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামপুর এলাকার মৃত তাঁরা মিয়ার ছেলে। ঢাকার বসুন্ধরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে তার দু’বার অপারেশন করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে মেট্রোপলিটন সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (২৭ জুলাই) কোটা না বুঝার এই গাড়িচালক আবুজর ইসলাম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।

রোববার (২৮ জুলাই) পশ্চিম শ্যামপুর এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

আবুজরের মা সুফিয়া বেগম বিলাপ করে বলেন, মরার আগে আমার বুকের ধন আমাকে কইছিল মাগো। কষ্ট করে হলেও আমাকে বাঁচাও মা।

তিনি আরো বলেন, ৬ বছর বয়সে বাপকে হারাইছে আবুজর। তিনটি ছোট ছোট ছেলে সংসারে রেখে ওর বাপ মারা যায়। তাদের অনেক কষ্টে করে বড় করেছি। আবুজর ছিল আমরা ছোট ছেলে, বুকের ধন, চোখের মনি। ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় সুফিয়া বেগম।

সুফিয়া বেগম বলেন, দুই ছেলে বিয়ে করে আলদা থাকে। আমার কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। একমাত্র আমার আবুজরই আমাকে দেখাশোনা করতো। সংসারের সব খরচ চালাতো।
মায়ের প্রতি আবুজরের ছিল সীমানাহীন ভালোবাসা।

সোফিয়া বেগম বলেন, ‘আমার কষ্ট হবো কইরা কখনো বিয়ের কথা কয়ইতে পাইনাই। ঢাকা শহরে বসুন্ধরা এলাকায় এক বাসার মালিকের গাড়ি চালাতো চালাতো আবুজর।’

মা সুফিয়া বেগম আরো জানান, ‘গত শুক্রবার সন্ধ্যায় খবর আসে আমার আবুজরের পেটে গুলি লাগছে। খবরে শুনে আমার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। আমি যখন ছেলের সামনে গেছি জড়িয়ে ধরে বার বার কইছে মা আমাকে কষ্ট করে হইলেও চিকিৎসা করো, ভালো হয়ে সব টাকা দিয়ে দিমু। ছেলের জন্য ঋণ করে টাকা পয়সা মিল করে চিকিৎসা করলাম। তাওতো আমার বাবারে বাঁচাতেই পারলাম না------।’

আবুজরের বড় ভাই শাহিদুল বলেন, শুক্রবার (১৯ জুলই) সন্ধ্যায় হঠাৎ আমার মোবাইলে এভার কেয়ার হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেন আবুজরের পেটে গুলি লাগছে। খবর পেয়ে আমরা রাতেই এভার কেয়ার হাসপাতালে যাই। সেখানে ডাক্তার বলেন, অপারেশন করতে হবে। পরে ওই দিন রাতেই অপারেশন করানো হয়। অপারেশন করানোর পর আমার ভাইয়ের শরীরের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হতে থাকে। ডাক্তাররাও বলেন, তার অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ডাক্তাররা অন্য হাসপাতলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শে তাকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে আবার অপারেশন করার জন্য বলেন ডাক্তাররা। পরে সেখানেও আরেকবার অপারেশন করা হয়। ওই অপারেশনের পরে শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়। গত শনিবার (২৭ জুলাই) রাত ১০টার দিকে রক্ত যোগাড় করতে বাইরে যাই। এমন সময় হাসপাতাল থেকে খবর আসে আবুজর আর বেঁচে নাই।

তিনি বলেন, ‘ভাইকে বাঁচানোর জন্য কত কষ্ট করলাম, তবুও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না। বাড়ি করার জন্য ইট কিনেছিলাম, সেইটাও বিক্রি করে দিয়েছি। এলাকার বিভিন্ন লোকজনের কাছে টাকা-পয়সা ধার করে ভাইকে চিকিৎসা করেছি। এভার কেয়ার হাসপাতালে বিল দিয়েছি সাড়ে ১১ লাখ টাকা এবং মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ২ লাখ ৯ হাজার টাকা বিল দিছি। এখন কিভাবে এত টাকা দিমু। আল্লাহই জানেন।

মেলান্দহ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী দিদার পাশা বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আবুজরের বাড়িতে খোঁজখবর নিয়েছি। তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার প্রয়োজন। জামালপুরের জেলা প্রশাসকের সাথেও এ বিষয়ে কথা বলেছি।


আরো সংবাদ



premium cement