সেহেরির মাইকিং করায় ৫ যুবক পুলিশি হেনস্তার শিকার
- জামালপুর প্রতিনিধি
- ১৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:২৭
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় রমজানে সেহেরি খেতে লোকজনকে ঘুম থেকে জাগানো (কাফেলা পার্টি) মাইকিং করার অপরাধে পুলিশী হেনেস্তার শিকারের অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী পাঁচ যুবক।
সোমবার দুপুরে ধর্মমন্ত্রীর কাছে ভুক্তভোগীদের কয়েকজন পুলিশি হেনেস্তা হওয়ার বর্ণনা করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে ইসলামপুর থানা মোড়স্থ জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে ডেকে নিয়ে অভিযুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে ভুক্তভোগীদের কাছে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা শুনেন ধর্মমন্ত্রী। পরে সমঝোতা করে দেয়ার কথা বলেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সেহেরি খেতে লোকজনকে ঘুম থেকে জাগাতে মাইকিং করার দায়ে পুলিশের ইসলামপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) অভিজিত দাস তাদের হেনেস্তা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করে জামালপুর-২ ইসলামপুর আসনের ও ধর্মমন্ত্রী মো: ফরিদুল হক খান দুলালের কাছে পুলিশি হেনেস্তার ঘটনার বর্ণনা করেছেন ওই পাঁচ যুবক। এ নিয়ে সর্বমহলে পুলিশের কার্যক্রম নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
তবে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার দাবি, ‘ঘটনাটি ভিন্নখাতে নেয়া হচ্ছে। মূলত উচ্চ শব্দের মাইকে গান বাজানোর দায়ে ওইসব যুবককে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছিল।’
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয়ভাবে রমজানে রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানো জন্য মাইকিংয়ের এই সংগঠনকে কাফেলা পার্টি বলা হয়। এটি ইসলামপুরের শত শত বছরের ঐতিহ্য। এক সময় মাইক ছিল না। ওই সময় এই কাফেলা পার্টি পরে মুখ দিয়ে পায়ে হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানো হতো।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছরের মতো এবারো রমজানে সেহেরি খেতে পৌরবাসীকে ঘুম থেকে জাগাতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন একটি মাইকিং দল (কাফেলা পার্টি)। রমজানের দ্বিতীয় দিন গত মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টার দিকে পাঁচজন যুবক পৌর শহরের বিভিন্ন গলি দিয়ে মাইকিং শুরু করে। এতে প্রথম দিনই বিপত্তি বাঁধান পুলিশের এএসপি অভিজিত দাস। তিনি মাইকিংকারী পৌর শহরের কিংজাল্লা গ্রামের জবেদ আলীর ছেলে মো: মন্তু শেখ (৩৭), ফকিরপাড়া গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে জনি মিয়া (২৮), গোয়ালেরচর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের ছেলে বাবু মিয়া (৩৫), পাশের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুঠ ইউনিয়নের দক্ষিণ বীর হাতিজা গ্রামের কিতাব আলীর ছেলে আক্তার মিয়া (৪৪) এবং পশ্চিম বীর হাতিজা গ্রামের ফজল হকের ছেলে ফরিদ মিয়াকে (৪৫) পুলিশি হেনস্তা করেন।
ভুক্তভোগী আক্তার মিয়া বলেন, ‘আমিসহ ফরিদ এবং বাবু সেহেরি খেতে লোকজনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে ওই দিন রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধু মোড় এলাকা মাইকিং করি। এ সময় গাড়ি থেকে বের হয়ে এএসপি অভিজিত দাস মাইকিং করার দায়ে অকত্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ আমাদেরকে মারধর করে থানা হাজতে আটকে রাখে। আমাদের মোবাইল কেড়ে নেয়। পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগ করতেও দেয়নি। থানা হাজতে আমাদের সেহেরি খেতে দেয়নি। ভোর রাতে পৌর কাউন্সিলর মোহন মিয়ার হস্তক্ষেপে আমরা মুক্তি পাই।’
ভুক্তভোগী আক্তার মিয়ার মা আমেনা বেগম বলেন, ‘ফজরের নামাজের পর ছেলে আক্তার বাড়ি ফিরে। পুলিশ সেহেরির খাবার না দিলেও বিনা খাবারে সেদিন পোলা আমার রোজা রেখেছিল। আমার পোলার কোনো দোষ ছিল না। রোজা রাখতে মানুষকে জাগাতে মাইকিং করায় পুলিশ আমার পোলারে মারছে। আল্লাহ পুলিশের বিচার করব।’
ভুক্তভোগী জনি মিয়া বলেন, ‘ইসলামপুর টিএনটি অফিসের সমানে থেকে রাত ৮টার দিকে আমাকে এবং মন্তু শেখকে ধরে থানায় নিয়ে যায় এসআই রফিকুল ইসলাম। প্রথমে আমাদের নারী ও শিশু ডেস্কে রাখা হয়। পরে এএসপি অভিজিতের নির্দেশ আমাদেরকে হাজতে রাখে। বিনা অপরাধে আমার গায়ে পুলিশ হাত তুলেছে। সেহেরি না খেতে পেরে রোজা রাখতে পারিনি।’
ভুক্তভোগী ফরিদ মিয়া বলেন, ‘থানায় সেহেরির খাবার না দেয়ায় রোজা রাখতে পারিনি। বিনা অপরাধে এএসপি অভিজিত দাস আমাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে এবং এই অঞ্চলের শত শত বছরের ঐতিহ্যের ওপর আঘাত করেছে। আমাদের পক্ষ থেকে ধর্মমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। তিনি এএসপি অভিজিতকে ডেকে ঘটনাটি শুনেছেন।’
ভুক্তভোগী মন্তু শেখ বলেন, ‘আমরা ওই দিনের পুলিশি নির্যাতনের বিচার চেয়ে ধর্মমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। ডাকবাংলোতে এএসপি অভিজিত দাসকে ডেকে নিয়ে আমাদের হেনেস্তার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ধর্মমন্ত্রী। মন্ত্রী সাহেব আমাদের ধৈর্য ধরতে বলেছেন।’
ইসলামপুর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহন মিয়া বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে ভোর রাতে থানায় যাই। তখন সম্ভবত ফজরের নামাজের আজান হয়েছে। পরে ওসি সাহেব ভুক্তভোগীদের আমার জিম্মায় ছেড়ে দেন। ভুক্তভোগীরা পুলিশি নির্যাতনের বিষয়টি ধর্মমন্ত্রী মহোদয়কে অবগত করেন। ডাকবাংলোতে ভুক্তভোগী মন্তু শেখের উপস্থিতিতে সেখানে এএসপি অভিজিত দাসকে ডেকে নেন মন্ত্রী মহোদয়। দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা করা হয়েছে। তবে ওই দিনের ঘটনাটি দুঃখজনক।’
ইসলামপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সুমন তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোর রাতে কাউন্সিল মোহন মিয়ার জিম্মায় পুলিশি হেফাজতে নেয়া ব্যক্তিদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সেহেরি খাওয়ার কথা বলা হলে তারা খেয়েছে বলে জানিয়ে ছিল।’
পুলিশের ইসলামপুর সার্কেলের এএসপি অভিযুক্ত অভিজিত দাস সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাত ২টার থেকে উচ্চ শব্দে মাইকে মিউজিকের আওয়াজ শুনি। পরে আমাদের জরুরি পার্টি দিয়ে মাইকিং করা লোকদের থানায় আনা হয়। তাদেরকে রাত ৩টার পর থেকে কম সাউন্ডে মাইকিং করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কাউকে মারধর কিংবা নির্যাতন করা হয়নি।’
রাত ৩টার দিকে থানায় পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন মাইকিংকারীদের সেহেরি খেতে দেয়া হয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রথমে সেহেরি খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বললেও পরে এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর না দিয়ে আমতা আমতা করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে অগণিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ বেশকিছু জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘রোজা রাখতে মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলতে মাইকিংকারীদের পুলিশ থানায় আটক রেখে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। এটা ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া এটি এই অঞ্চলের শত শত বছরের ঐতিহ্য। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ধর্মমন্ত্রী মো: ফরিদুল হক খান দুলালের সাথে যোগাযোগ করতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তার ব্যবহৃত মোবাইলফোন বন্ধ থাকায় কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা