২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইউরোপপ্রবাসী ছেলেদের হাতে শিল্পপতি বাবা রক্তাক্ত, বাসা থেকেও বিতাড়িত

বাবা এবং দুই ছেলে - ছবি : সংগৃহীত

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পশ্চিম কুর্শা গ্রামের শিল্পপতি বাবাকে তার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান এবং ইউরোপের নাগরিক ও ইউরোপের বসবাসকারী ছেলে মিলে মারধরে রক্তাক্তে আহত করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছেলেরা তাকে তার নিজের বাসা থেকেও বিতারিত করেছে বলে জানা গেছে। বাবা নিরাপত্তাহীনতায় আইনের সহযোগিতা কামনা করেও রেহাই পাচ্ছেন না সন্তানের নির্যাতন থেকে। আইনের আশ্রয় চেয়েও ভয়ে আছে জীবননাশের অবিরত হুমকির মুখে। এলাকার সুশীল সমাজের লোকজনের ভাষ্য, অতি দরিদ্র হালত থেকে নয়-ছয়ে উপার্জিত অর্থের মাধ্যমে কোটিপতি বনে যাওয়ার কারণেই একের পর এক এই পরিবারের সদস্যদেরকে ঘিরে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা, দ্বন্দ্ব, কলহ ও সংঘাতের ঘটনা এখন চরমে।

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদরের পশ্চিম কুর্শা গ্রামের নিকলীর ইটভাটা শিল্পের মালিক ও নিকলী থানা আ'লীগের উপদেষ্টারমণ্ডলীর সদস্য হাজী মো. রূপালীকে তার ছেলে ইউরোপের দেশ অষ্ট্রিয়ায় বসবাসকারী কামরুজ্জামান নজরুল ও অষ্ট্রিয়ার নাগরিক তাজিরুল ইসলাম তাজুল মিলে অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে হুমকি ও শারীরিক মানসিক নির্যাতন চালিয়ে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, গত ১৭ অক্টোবর বিকাল ৪টায় বাড়ি-সংলগ্নে ইটখলার গদিঘরে ঢুকে তাজুল তার পিতাকে মারধরের উপক্রম ঘটালে ভয়ে তখন বাবা বেরিয়ে যান। এ সময়ে দায়িত্বে থাকা কর্মচারী হারুন মুন্সি ও লোকমানকেও ঘর থেকে বের করে দিয়ে চাবি নিয়ে তালা আটকে দেয়া হয়। এছাড়াও প্রকাশ্য খুন করারও হুমকি দেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। তখন ক্যাশ থেকে তাজুল ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকাও নিয়ে যান কলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এছাড়াও বাবাকে কিশোরগঞ্জের বাসা থেকেও তারা বের করে দেন।

এই ঘটনায় গত ১৭ অক্টোবর নিকলী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন রূপালী মিয়া। অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুজনকে নিকলী থানায় ধরে নিয়ে গেলেও স্থানীয় নেতাকর্মী ও স্বজনেরা আপস মীমাংসার লক্ষ্যে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। মীমাংসায় ব্যর্থ হলে পরবর্তী ৪ ফেব্রুয়ারি অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে আবারো সেই গদিঘরে প্রবেশ করে পিতাকে লোহার রড দিয়ে তাজুল মাথায় আঘাত করেন। নজরুল কিল ঘুষিতে পিতাকে আহত করেন। তাকে প্রথমে নিকলী সদর হাসপাতালে ও পরবর্তীতে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়। এই ঘটনায় নিকলী থানায় পুনরায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন পিতা রূপালী মিয়া। অভিযোগের ভিত্তিতে এ সময়েও স্থানীয়ভাবে আপস মীমাংসার লক্ষ্যে আবারো বাড়িতে সালিশ বৈঠক হয়। এ সময়ে ২ কোটি টাকা ছেলেদের দেয়ার বিষয়ে মতপোষণ করলে নিরূপায় হয়ে সাময়িক মেনে নিলেও পরে ন্যায়বিচারের আশায় আপত্তি তোলেন। রায়ের পরবর্তী পর্যায়ে ১ কোটি টাকার স্বাক্ষরিত ইসলামী ব্যাংকের চেকও দিতে বাধ্য হন বলে জানান।

ইটভাটা রূপালীর অপর ছোট এক প্রবাসী ভাইয়ের সাথে যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও তাজুল ও নজরুলের ভাষ্য হলো, তারা পিতার কাছে অষ্ট্রিয়া থেকে কোটি কোটি টাকা পাঠিয়েছেন। এ সব দ্বিতীয় সংসার আর ইটভাটা ব্যবসায় কাটাচ্ছেন। তাই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তারাও পিতার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন উক্ত থানায়।

ইট ভাটা মালিক রূপালী মিয়ার ভাষ্য, প্রথম সংসারের সন্তান নজরুল ও তাইজুল প্রায় সময়ে মুঠোফোনে বিদেশ থেকেও জীবননাশের হুমকি দিতো। উল্লেখ্য, অভিযোগ রয়েছে যে নজরুল ও তাজুল বিদেশে লোক নেয়ার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার কারণে মামলা মোকদ্দমা হয়। ফলে ৩৯ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে তাদের। ইউরোপে নেয়ার কথা বলে লোকজনের সাথে প্রতারণায ফলে নানাভাবে লাঞ্ছিত তার পরিবারের লোকেরাও। তাছাড়া নজরুল নিয়মিত নেশা করে‌ন বলে অভিযোগ রয়েছে। যেকোনো সময়ে মাদক সেবন করে অর্থের লোভে তাকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারেন বলেও ভয়ে আছেন।

বিভিন্ন সময়ের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, নজরুল নিয়মিত একজন মাদকসেবী ও কুখ্যাত জুয়ারি। যাকে ক্যাসিনো নজরুল নামেই ইউরোপে অনেকেই চেনে। তিনি ২০০৭ সাল থেকে মানব পাচার ও মাদক নেশায় সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য মামলার পাশাপাশি ভিয়েনাতেও ২০১৪ সালে মাদক জাতীয় জটিল এক মামলাতে তিন বছর কারাবাস করে বলে জানা গেছে। এছাড়াও অষ্ট্রিয়াতে নজরুলের নামে ২০২০ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে এবং তাজিরুলের নামে ২০১৯ সালের ২২ আগষ্ট পৃথক দুটি সন্ত্রাসী মামলার অভিযোগ পাওয়া যায়।

জানা গেছে, বাংলাদেশের বহু লোককে ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে পথে বসিয়েছেন পাচারকারী চক্রের হোতাদের অন্যতম নজরুল। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি বাংলাদেশ থেকে। এখন তারা ইউরোপের সুবিধা ভোগ করে চলেছেন। ইউরোপে তারা বেশ টাকার মালিক। বাংলাদেশে অপরাধ করে গা ঢাকা দেয়ার অবস্থানও তৈরি করে নিয়েছে অষ্ট্রিয়াতেই। অর্থ আত্মসাতের কারণে মামলা মোকদ্দমা হলে দীর্ঘদিন নজরুল ইউরোপের দেশ অষ্ট্রিয়াতেই ছিলেন বলেও জানা যায়।

ইউরোপে বসবাসকারী নজরুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি ইউরোপে লোক নেয়ার সময়ে যে টাকা-পয়সা নিয়েছিলাম তা বাবার কাছেই দিয়েছি। তাই মানুষের পাওনা টাকা বাবাকেই দিতে হবে, এটা স্বাভাবিক। এইসব এখনকার ঘটনার বিষয় না। বাবা আমাদের অধিকার বঞ্চিতের চেষ্টা করে চলেছে। তাই আমরাও অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে চলেছি। আমি তাকে মারধর করিনি। আমিও থানায় অভিযোগ করেছি বাবার নামে। বাকি সকল প্রকার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

তাজিরুল ইসলাম তাজুল জানান, আমি অষ্ট্রিয়ার নাগরিক। আমরা অষ্ট্রিয়া থেকে কোটি টাকা দিয়েছি বাবার একাউন্টে। খোঁজ নিয়ে দেখুন ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ইসলামী ব্যাংক থেকে জেলার শ্রেষ্ঠ রেমিট্যান্স উত্তোলনকারী হিসেবে পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ছোট ভাই তারিকুজ্জামান মিঠুকে মারতে যাওয়ার সময়ে বাবা আমাকে চুলে ও শার্টের কলারে ধরলে আমি ছোটার চেষ্টা করলে হয়তো মাথায় আঘাত লেগে থাকতে পারে। তবে আমি তাকে মেরে রক্তাক্ত করিনি। বাকি সব অভিযোগ তিনিও অস্বীকার করেন।

আলতাফ ব্রিক ফিল্ডের মালিক ও থানা আ'লীগের উপদেষ্টা হাজী মোঃ রূপালী মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, তাজুল ও নজরুল আমার প্রথম স্ত্রী সন্তান হলেও অর্থের নেশায় যে কোনো সময়ে আমাকে খুন করতে পারে বলে ভয়ে আছি। ওদের দালালি ও প্রতারণার কারণে অতীতেও ৩৯ লাখ টাকা জরিমানা দিয়েছি এমনকি বহুবার লাঞ্ছিত হয়েছি। কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার মনিপুরের ৫ তলা ৪৪০/৪ রূপালী ম্যানশন থেকেও বিতাড়িত করে দিয়েছে আমাকে। ৪ ফেব্রুয়ারি আমাকে খুন করার উদ্দেশ্যে মারধর করেছে। নির্যাতন আর জীবননাশের ভয়ে থানার ওসি এবং এসপি সাহেবের কাছেও আগেও গিয়েছি। হুমকি অব্যাহত রয়েছে। ভয়ে কোটি টাকার চেকও দিয়েছি‌। আমি এদের বিরুদ্ধে আইনি বিচার চাই।

নিকলী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক আয়াজ এই ঘটনার বিষয়ে বলেন, এদের পারিবারিক সমস্যার শেষ নেই। কয়েক দিন পর পরই অভিযোগ আর অভিযোগ। পিতা-পুত্রের বিষয়টি থানায় অভিযোগের পরে আমরা সালিশে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে বিরোধ শেষ করে দিয়েছি। পরে কী হলো, এটা আর আমাকে কেউ জানায়নি। আরো অনেক গন্যমান্য সালিশেও তখন সেখানে ছিলেন।

নিকলী থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ এস. এম. শাহাদাত হোসেনের কাছে এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাওয়ার জবাবে তিনি নিজে থেকে বলেন, এই বিষয়টি পিতা-পুত্রের এবং সম্পূর্ণ পারিবারিক। পারিবারিক বিষয়ে আমাদের স্বেচ্ছায় হস্তক্ষেপের কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া পিতা যদি নির্যাতনের শিকার হয়ে মামলা করতেই চান তাহলে সেক্ষেত্রে সব সময়ে আইনি সহায়তা পাবেন। থানার আসার পরে স্থানীয়দের মাধ্যমে আপসের চেষ্টা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার শেখ রাসেল আহমেদ পিপিএম বার বলেন, অপরাধী ছেলে হোক আর মেয়ে হোক অপরাধী অপরাধীই। নির্যাতিত হলে পিতা যদি আইনের আশ্রয় নিতে চান সেক্ষেত্রে সুযোগ রয়েছে। আইন সবার জন্যে সমান বলেও তিনি উল্লেখ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement