২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঈশ্বরগঞ্জে ভাতার টাকা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় প্রতারক চক্র

ভাতার টাকা হারিয়ে অসহায় ভাতাভোগীরা
ঈশ্বরগঞ্জে ভাতার টাকা হাতিয়ে নিতে সক্রিয় প্রতারক চক্র - ছবি : নয়া দিগন্ত

কপালে হাত রেখে কাঁদছিলেন জমিলা চারপাশ ঘিরে তৈরি হয় জটলা। সামনে এগিয়ে যেতেই এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরে জনতার একাংশ। ভাতার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র।

উপস্থিত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের চরহোসেনপুর গ্রামের বিধবা জমিলা বেগমকে সমাজসেবা অফিসের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কেউ একজন কলদেন। ফোনে জরুরি তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে বলেন। না হলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আসতে হবে বলে জানান।

জমিলা ভাবলেন, বিষয়টা যখন জরুরি সমাজসেবা অফিসে যাওয়ার চেয়ে বিকল্প পদ্ধতিটাই উত্তম। তাই তিনি সরল বিশ্বাসে বিকল্প অপশনেই রাজি হলেন এবং তার মোবাইলের মেসেজে আসা কোড নম্বরটি জানিয়ে দিলেন কলারকে। এরপরে তাকে জানানো হয় তার তথ্য আপডেট হয়েছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মোবাইলে ভাতার টাকা চলে যাবে। এরপরে তার ব্যালান্স চেক করতে গিয়ে দেখেন অ্যাকাউন্ট শূন্য। ঘটনাটি ঘটে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে।

জানা যায়, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার হতদরিদ্র মানুষের ব্যক্তিগত ‘নগদ’ একাউন্টে আসা সরকারি ভাতার লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র।

সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যাক্ত ও শিক্ষা উপবৃত্তির টাকা ভাতাভোগীদের একাউন্টে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে সুকৌশলে এসব টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

সমাজসেবা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় বয়স্কভাতা সুবিধাভোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৩৩৮ জন। বিধবাভাতা পাচ্ছে নয় হাজার ৪০৯ জন, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তির সংখ্যা নয় হাজার ৮৫৬ জন, বেদে-৩৯, হিজড়া-৪, প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির সংখ্যা ২১৬ এবং অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি পাচ্ছেন ৩৪ জন।

ভাতাভোগী ও সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায় বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ও শিক্ষা উপবৃত্তি ভাতার ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা ছাড়করণ শুরুর খবর জেনে সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। এভাবেই সমাজসেবা অফিসের নাম ভাঙিয়ে কল করে ভাতাভোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা ও মোবাইল অ্যাকাউন্টের পিন নম্বর। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন ভাতাভোগীকে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে নগদ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়ে টাকাসহ গোপন পিন নম্বর নিয়ে গেছে প্রতারক চক্রটি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ সমাজসেবা কার্যালয়ে এসে জানালেও কোনো সুরাহা মিলছে না। এক্ষেত্রে সমাজসেবা অফিস বলছে তাদের কাছে কোনো ভুক্তভোগীই লিখিত অভিযোগ করেননি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সমাজসেবা অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও নদগদের সাথে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে চলছে এমন প্রতারণা। তারা বলেন, কর্মকর্তারা জড়িত না থাকলে আমাদের নাম ঠিকানা ও ভাতা দেয়ার সঠিক সময় প্রতারক চক্র কিভাবে জানে।

প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভাতাভোগীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভাতা দেয়ার সময় সমাজসেবা অধিদফতর ও নগদ অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়ে ফোন করে বলেন, আপনার ভাতার টাকা মোবাইল একাউন্টে পাঠানো হবে অথবা আপনার তথ্য আপডেড করতে হবে অথবা আপনাকে স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে দয়া করে আপনার মোবাইলে প্রেরিত কোড (ওটিপি) নম্বরটি বলেন। নম্বর বলার সাথে সাথে তারা নগদ একাউন্টের এক্সেস তাদের হাতে নিয়ে নিচ্ছে পরে নগদে টাকা আসার সাথে সাথে টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের ভাটিচড়নওপাড়া গ্রামের বয়স্ক ভাতাভোগী শামছদ্দিনকে ০৯৬৩৮১৯৫৩২২ নম্বর থেকে ফোন করে বলে আপনার নম্বরটি অনলাইন হয়নি আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন না হলে আপনার ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর কথার প্যাচে ফেলে হাতিয়ে নেয়া হয় গোপন পিন নম্বর। তারপরই নগদ একাউন্টে আসা ভাতার এক হাজার ৮০০ টাকা উদাও হয়ে যায়।

সদর ইউনিয়নের দড়ি পাঁচাশি গ্রামের বয়স্ক ভাতাভোগী হাছেন আলীর মোবাইল ফোনে ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে একটা কল আসে। উপজেলা সমাজসেবা অফিসের স্টাফ পরিচয় দিয়ে তাকে জানানো হয়, আপনাকে স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে। তাই দয়া করে আপনার মোবাইলে প্রেরিত কোড (ওটিপি) নম্বরটি বলেন। নম্বরটি বলার সাথে সাথে সংযোগটি কেটে দেয়। বিষয়টি সমাজসেবা অফিসকে অবহিত করলে তারা জানান, এটি প্রতারক চক্রের কাজ। পরে তিনি নগদ একাউন্টি অফিসে ফোন করে বন্ধ রাখার জন্য অনুরোধ করেন।

এসব অভিযোগ পাওয়ার পরে রোববার দুটি নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করে পরক্ষণেই লাইন কেটে দিয়ে নম্বরটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরে অনেকবার ওই দুটি নম্বরে কল করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো: হাসান কিবরিয়া বলেন, সমাজসেবা অফিস থেকে কখনোই কাউকে ফোন করা হয় না। এগুলো প্রতারক চক্রের কারসাজি। তারা নানা কৌশলে আগে ভাতাভোগীদের তথ্য সংগ্রহ করে। এরপরে তাদের ফোন করে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিয়ে কথার মারপ্যাঁচে ফেলে গোপন পিন নম্বর সংগ্রহ করে এবং টাকা হাতিয়ে নেয়।

বর্তমানে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ত্রৈমাসিক কিস্তির টাকা ছাড়করণ শুরু হয়েছে। এই খবর পেয়েই হয়তো সক্রিয় হয়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। তাই পরিচয় যা-ই দিক না কেন মোবাইল ফোনে কখনোই কাউকে কোনো তথ্য, কোড কিংবা পিন নম্বর দিতে নিষেধ করেন তিনি। এ উপজেলায় ভাতার প্রতারণার বিষয়টি তিনি শুনেছেন তবে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। যদি কেউ প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন তাহলে তাকে থানায় জিডি করে তাদের কাছে জানালে তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে অবহিত করবেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরিফুল ইসলাম প্রিন্স বলেন, বিষয়টি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সভায় গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয়েছে। মোবাইল ফোনে কখনোই কাউকে কোনো তথ্য, কোড কিংবা পিন নম্বর দিতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও কেউ এ ধরণের প্রতারণার শিকার হলে ভাতাভোগীকে জিডি করতে বলা হয়েছে। ভাতাভোগীদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সমাজসেবা অফিসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement