গৌরীপুরে ছত্রাকজনিত রোগে আলুচাষিদের ব্যাপক ক্ষতি
- গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) সংবাদদাতা
- ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৪
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে ছত্রাকজনিত ‘লেইট ব্লাইট’ রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাষির আলুক্ষেত।
শনিবার দুপুরে আলু উত্তোলনের সময় উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চূড়ালী গ্রামে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
এ সময় স্থানীয় আলুচাষিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া ব্লকে চলতি মৌসুমে আলু চাষ হয়েছে ৭০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে চল্লিশা আলু ২৯ হেক্টর, উফশী এক হেক্টর এবং চল্লিশা থেকে জাত উন্নয়ন ঘটানো বার্মিজ আলুর চাষ হয়েছে ৪০ হেক্টর। এ ব্লকেই সবচেয়ে বেশি ‘লেইট ব্লাইট’ নামক ছত্রাকের মড়ক দেখা দিয়েছে। ছত্রাকের আক্রমণে ফলন কম হওয়ায় আগাম নেয়া টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে অনেক চাষির, আবার পাইকাররাও জমি নিতে চাচ্ছেন না। ফলে ক্ষতির মুখে চাষি ও পাইকার উভয়পক্ষই।
সরেজমিনে চূড়ালী গ্রামে দেখা গেছে, সারিবদ্ধভাবে নারীরা আলু তোলায় ব্যস্ত। ১৫০ টাকা রোজ হিসেবে আলু তুলছেন জমিলা খাতুন ও হাজেরা খাতুন।
তারা বলেন, ‘অন্যবারের তুলনায় জমি থেকে আলু পাওয়া যাচ্ছে খুব কম। জমিতে আলু তোলাচ্ছেন পাইকার আবদুল মোতালেব। প্রতি কাঠা জমির আলু তুলতে খরচ পড়ছে ৩০০০ টাকা। আলু কম পাওয়ায় হতাশ তিনি। কাঠায় ২০ মণের মতো আলু পাওয়া গেলেও এবার পাচ্ছেন ৮ থেকে ১০ মণ।’
স্থানীয় আলুচাষি জুবেদা খাতুন জানান, ‘তিনি ১২০ শতক জমি ইজারা নিয়ে আলু চাষ করেন। তার আলুক্ষেতে ছড়িয়ে পড়ে ছত্রাক। ৩০ হাজার টাকা দাদনে নিয়ে ওষুধ ছিটিয়েও রক্ষা হয়নি। ক্ষতি পোষাতে এখন ১৫০ টাকা দিনমজুরি খাটছেন তিনি।’
কৃষক মোমিন মিয়া জানান, ‘তিনি ৬০ শতাংশ জমি চাষ করেছেন। এর মধ্যে মাত্র ২৭ শতক জমির আলু বিক্রি করতে পেরেছেন। বাকি জমি নিচ্ছেন না পাইকাররা। জমি চাষ করতে ৩০ হাজার টাকা খরচ হলেও ওষুধ দিয়েছেন আরো ২০ হাজার টাকার।’
তার স্ত্রী আসমা বেগম বলেন, ‘২৭ শতক জমি ২৯ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। তার অর্ধেক টাকাই ওষুধের দোকানে দিতে হয়েছে। দাদনে টাকা নিয়েও ওষুধ ছিটিয়েছি। তার পরও আলু রক্ষা করা যায়নি। কোনো ওষুধই কাজ করেনি।’
কৃষক মারফত আলী বলেন, ‘তিনি ৩০ শতক জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। সাধারণত আলু চাষ করতে কাঠা প্রতি ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়। এবার রোগের কারণে কাঠা প্রতি আরো ২০০০ টাকার ওষুধ ছিটাতে হয়েছে। তাতেও লাভ হয়নি।’
একই অবস্থা ৮০ শতক জমি চাষ করা কৃষক আব্দুস সালামেরও। বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের ওষুধ ছিটিয়েও রক্ষা পায়নি জমি।
কৃষকের উৎপাদিত আলু কলতাপাড়া বাজারে আলুর মোকাম থেকে বিক্রি হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কিনে নেন আলু। প্রতি বছর ভরা মৌসুমে আলুর মোকামে ব্যবসায়ীর ভিড় থাকলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। মোকামে আলুর সরবরাহ অনেক কম। স্থানীয়ভাবে ১৬০০ টাকা মণ হিসাবে আলু বিক্রি হতে দেখা গেছে।
কৃষকের কাছ থেকে আগাম আলুক্ষেত কিনে বিপাকে পড়েছেন পাইকাররাও। অন্য মৌসুমে ১০ শতক জমিতে যে পরিমাণ আলু পাওয়া যেতো, এবার তার অর্ধেকের চেয়েও কম আলু পাওয়া যাচ্ছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ‘চলতি বছর জেলায় ৩৫১৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আলুর চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গৌরীপুর উপজেলায় চাষ হয়েছে ৪৫০ হেক্টর। এ উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে কমপক্ষে দুই যুগ আগে শুরু হয় চল্লিশা আলু চাষ। আমন ও বোরো মৌসুমের মাঝের ফাঁকা সময়টিতে চল্লিশা আলু চাষ করেন চাষিরা। স্থানীয় বাজার ছাড়াও নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের উপজেলাগুলোতেও চল্লিশা আলু কিনে নেয় পাইকাররা।
ফসল তোলার আগ মুহূর্তে ছত্রাকজনিত এ রোগের সংক্রমণের কারণ হিসেবে কৃষি বিভাগ বলছে ‘বৃষ্টি, ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে এমনটি হয়েছে।’
আলু পাইকার মামুনুর রশিদ বলেন, ‘প্রতি শতক জমি ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকায় কৃষকের কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। জমিতে আলু ফলন আসার পরই কৃষকের অগ্রিম টাকা দিয়ে কিনে ফেলা হয়। এবার ৬০ কাঠা জমি কিনেছিলেন। প্রতিবার কাঠা প্রতি ১২ থেকে ২০ মণ আলু উঠলেও এবার পাওয়া যাচ্ছে ৬ থেকে ৮ মণ। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা। জমিতে আলুর ফলন ভালো না হওয়ায় কৃষকের অগ্রিম টাকা ফেরত চাওয়া হচ্ছে।’
স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া ও বৃষ্টির কারণে এমন ক্ষতি হয়েছে। চাষিদের কাছ থেকে আগাম আলুক্ষেত কিনে নেন পাইকাররা। ছত্রাকের আক্রমণ হওয়ার আগে কিংবা সাথে ওষুধ প্রয়োগ করলে এমন ক্ষতি হতো না। কিন্তু কৃষক জমি বিক্রি করে আর খবর না রাখায় এবং পাইকারও বিষয়টি নজর না রাখায় দ্রুত এক জমি থেকে অন্য জমিতে রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।’
তার দাবি, ‘কৃষক বাজার থেকে ছত্রাকনাশক কার্জেট এম ব্যবহার করলেও এ বছর কাজ করেননি। তার পরিবর্তে জ্যামপ্রো ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়। যারা সেটি ব্যবহার করেছেন, তাদের জমি রক্ষা পেয়েছে।’
গৌরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন জলি জানান, ‘উপজেলার ১৫০ হেক্টর জমিতে সংক্রমণ হলেও ১০০ হেক্টর জমি নিরাময় হয়েছে। ছত্রাকের আক্রমণের কারণে ফলন একটু কম হয়েছে।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা