কৃত্রিম অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিকল্প হবে আমের বীজের নির্যাস
- মো: লিখন ইসলাম, বাকৃবি
- ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:১৯, আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:১৯
মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকই প্রধান ভরসা। তবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সারাবিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি বৈশ্বিক হুমকি। গবেষণার তথ্যমতে, অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণে ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ১২ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবীরা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং সেগুলো দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়।
পরিত্যক্ত আমের বীজের কার্নেল বা আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণে প্রাথমিক সফলতা পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক, যা গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়া এবং মিথিসিলিন ও পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতেও সক্ষম।
আমের আটির গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বাকৃবির মাইক্রোবায়োজলি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: গোলজার হোসেন ও তার গবেষক দল এসব সাফল্য পেয়েছেন।
আমের আঁটির নির্যাস থেকে নিষ্কাশিত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, যা সিন্থেটিক বা কৃত্রিমভাবে তৈরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের বিকল্প হবে বলে দাবি করেছেন ওই গবেষক।
প্রবল সম্ভাবনাময় গবেষণাটি নিজস্ব অর্থায়নে ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হয়। গবেষক দলে আরো ছিলেন মাইক্রোবায়োজলি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকুমার সাহা, ফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শারমিন আক্তার, কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিপ্লব কুমার সাহা, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী রাহীলা জান্নাত সাদিয়া, চন্দন সিকদার, আনন্দ মজুমদার, মোসলেমা জাহান মৌ এবং নাজমুল হাসান সিয়াম।
আমের আঁটি থেকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান তৈরির বিষয়ে ড. গোলজার বলেন, বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে আম উৎপন্ন হয় এবং এর বীজ সাধারণত পরিত্যক্ত হয়। তাই আমরা দেশী জাতের আমের বীজের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেছি। আমরা রাসায়নিক পদ্ধতি ব্যবহার করে আমের পরিত্যক্ত বীজ থেকে একটি নির্যাস তৈরি করি, যা কিছু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইঁদুরে সেই নির্যাস পরীক্ষার সময় দেখা গেছে যে এর বিষাক্ততা নেই বললেই চলে এবং উচ্চ মাত্রায় নির্যাস প্রয়োগে ইঁদুরগুলোর লিভার ও কিডনিতে সামান্য পরিবর্তন দেখা গেলেও, উল্লেখযোগ্য কোনো খারাপ লক্ষণ দেখা যায়নি।
তিনি আরো বলেন, স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে আমের বীজের নির্যাস ব্যাকটেরিয়ার কোষের গঠন ধ্বংস করতে সক্ষম। এটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা তৈরি বায়োফিল্মও ধ্বংস করতে পারে। ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইঁদুরের ওপর এই নির্যাস প্রয়োগে ওই সংক্রমিত ইঁদুরগুলো দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠে।
আমের আঁটির অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল উপাদান প্রয়োগের ভবিষ্যত সম্ভাবনা নিয়ে গবেষক জানান, বর্তমানে আমরা পোলট্রিতে এই নির্যাস প্রয়োগের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। যদি সফল হই, এটি বাংলাদেশের পোলট্রি সেক্টর ও স্বাস্থ্যখাতে দৃশ্যমান অবদান রাখবে এবং অর্থনৈতিক সাশ্রয় সাধিত হবে, যা জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক হবে।
অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে প্রধান গবেষক ড. গোলজার হোসেন জানান, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) সারাবিশ্বে একটি বৈশ্বিক হুমকি। মানুষের পাশাপাশি প্রাণীর ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকই প্রধান ভরসা। তবে, অনেক ব্যাকটেরিয়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত সিন্থেটিক অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অ্যাজেন্টের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( ডব্লিউএইচও) এএমআরকে জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ভেষজ ওষুধগুলো সিন্থেটিক ওষুধের বিকল্প হিসেবে নিরাপদ, সুবিধাজনক এবং সাশ্রয়ী। ডব্লিউএইচও ভেষজ পরিত্যক্ত পদার্থ নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে অন্যতম। আমে বিভিন্ন ধরনের ম্যাক্রো ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে। আমের খোসা ও বীজের কার্নেল ঔষুধি গুণাগুণসম্পন্ন হলেও সাধারণত এই অংশগুলো পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। ইতোপূর্বে আমের খোসা ও পাতার অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল কার্যকারিতা নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে, তবে আমের বীজের (আঁটি) কার্যকারিতা নিয়ে বাংলাদেশে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা পাওয়া যায়নি। যদিও কয়েকটি দেশে এ বিষয় নিয়ে প্রাথমিক গবেষণা হয়েছে।
ড. সুকুমার সাহা বলেন, এই ক্রুড নির্যাসটির মধ্যে এমন কোনো কিছু আছে, যা কি না এই ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে। এখন আমাদের প্রধান কাজ, এই সক্রিয় উপাদানটি বের করার চেষ্টা করা। যে সক্রিয় উপাদানটি ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করেছে, সেটি যদি বের করা যায়, তবে আমি বলতে পারি যে বর্তমানে এটির যে বিষাক্ততা আছে, সেটির ৯৯.৯৯ ভাগ চলে যাবে।