২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

‘সাদা-কালা’ গানের গীতিকার হাশিম মাহমুদের জীবনটাই এখন সাদা-কালা

‘সাদা-কালা’ গানের গীতিকার হাশিম মাহমুদের জীবনটাই এখন সাদা-কালা - ছবি : নয়া দিগন্ত

‘তুমি বন্ধু কালা পাখি
আমি যেন কী?
বসন্তকালে তোমায়
বলতে পারিনি।
সাদা-সাদা কালা-কালা,
রঙ জমেছে সাদা-কালা,
হয়েছি আমি মন পাগলা বসন্তকালে...’

বর্তমান সময়ে মানুষের ঠোঁটের কোণে আটকে থাকা গান এটি। কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা এ গানের গীতিকার নারায়ণগঞ্জের হাশিম মাহমুদ। ফতুল্লার তল্লার সবুজবাগ এলাকায় আবুল হাসেম ও জমিলা আক্তার দম্পতির দশ সন্তানের মধ্যে হাশিম মাহমুদ পঞ্চম ছিলেন। শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভুগছেন তিনি। মায়ের সাথে এখানেই থাকেন তিনি। তবে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় এক সময় বেশ সময় কাটিয়েছেন তিনি। লিখেছেন আরো বহু গান। কোটি মানুষের হৃদয় জয় করা গানটির গীতিকার বর্তমানে ভালো নেই। তার জীবনটই এখন সাদা-কালা।

শ্রোতাদের কাছে হাশিম মাহমুদ অপরিচিত নাম হলেও নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, টিএসসি, ছবির হাটের পরিচিত মুখ তিনি।

শাহবাগের আড্ডায় গানটি নিয়মিত গাইলেও ‘হাওয়া’ সিনেমার সুবাদে শাহবাগ ছাপিয়ে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম। তিনি একাধারে কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও ছড়াকার। পঞ্চাশোর্ধ্ব এ শিল্পী অনেকটা নিভৃতে বাস করেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার তল্লা সবুজবাগ এলাকায়।

নারায়ণগঞ্জের এই কৃতি সন্তানের সাথে বৃহস্পতিবার কথা হয় নয়া দিগন্তের নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতার সাথে। পর্দার আড়ালে থাকা এই মানুষটির জীবন ও কথা জানান তিনি।

গানটি ছবিতে কিভাবে গেছে? প্রশ্ন করতেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘ছবিতে গেছে এটা? আমিতো জানি না।’ পাশ থেকে জানানো হয়, ছবির নাম হাওয়া। এরপর সেও হাওয়া শব্দটি দিয়েই গান ধরেন, দু’লাইন গেয়েই সুর হারিয়ে ফেলেন আচমকা।

হাশিম মাহমুদকে আবারো প্রশ্ন করা হয় আপনার গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে, এখন মোবাইল খুললেই আপনার হৃদয় ছোঁয়া সেই সঙ্গীত। কেমন লাগছে? প্রশ্নের উত্তরটি এক বাক্যে বললেন, ‘ভালো লাগছে’।

সাদা সাদা-কালা কালা গানটি কবে লিখেছেন, এই প্রশ্নটি করতেই উত্তর দিলেন, ‘এটা অনেক বছর আগে।’ শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলবেন কিনা, প্রশ্ন করতেই বললেন, ‘দর্শক জন্মায় গান শোনার জন্যই। ভালো গান শুনবে।’

এই সময়ে এসে পুরোনো দিনের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? প্রশ্ন করতেই এক মুহূর্তের জন্য ভাবনায় ডুবে গেলেন। চোখে মুখেও ভেসে ওঠে সেই ভাবনার ছাপ। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে উত্তর দিলেন, ‘বাড়ি ফিরতাম যখন। তখন কাঁধে ক্যানভাসের ব্যাগ ছিল। ব্যাগের ভেতর ছবি আঁকার পেন্সিল থাকত, রং তুলি থাকত। তখন বিভিন্ন রকম আর্ট করতাম।’ এরপর কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। উত্তরটাও দিলেন এলোমেলোভাবে।

হাশিম মাহমুদের বড় ভাই রাশেদুল হাসান জীবন নয়া দিগন্তকে জানান, ‘গান বাজনা তো আড্ডাবাজি। হাশিম আড্ডাবাজি করেই সময় কাটাতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সামনে একটু লাল চা আর একটি সিগারেটে তার ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেত। বর্তমানে তার গানটি যে মানুষ মুখে মুখে গাইছে, এটা আমাদের জন্য খুশির ব্যাপার। তবে বেশির ভাগ শিল্পীই মূল্যায়িত হয় না। একইভাবে আমার ভাইও মূল্যায়িত হয়নি। আমার ভাই শারীরিকভাবে একটু অসুস্থ। আমি চাই তিনি যেন সুস্থ্য হয়ে ওঠেন এবং জীবনের নিরাপত্তা পান। কেউ যদি আমার ভাইকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসতে চায়, তাহলে তারা আসতে পারে।’

হাশিম মাহমুদকে ছোট বেলা থেকে চেনে এমনই একজন সেলিম হোসেন । তিনি জানান, ‘নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলে পড়তেন হাশিম মাহমুদ। ছোট বেলা থেকেই গুন গুন করে গান গাইতেন। কণ্ঠের সুরও খুব ভালো। মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে আটকে রাখে তার গান ও কণ্ঠ। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। এক পর্যায়ে ঢাকামুখী হয়ে গেলেন, এরপর আমার সাথে তার যোগাযোগ কমে গেছে। বর্তমানে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। আমরা আশাকরি, তিনি যেন খুব দ্রুত সুস্থ্য হয়ে আমাদের কাছে ফিরে আসেন।’

নারায়ণগঞ্জ শহরে বেড়ে উঠলেও যৌবনের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন ঢাকাতে। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় তার ভরাট কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু গানে নয় কথাতেও মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন তিনি।

‘শাপলা’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন হাশিম মাহমুদ। যাতায়াত ছিল স্থানীয় সঙ্গীত বিদ্যালয় জয়জয়ন্তী জলসায়। পরে ঢাকার চারুকলা, মোল্লার দোকান, ছবির হাট, পাবলিক লাইব্রেরি ও শাহবাগ হয়ে ওঠে তার বিচরণক্ষেত্র। এক সময় ‘বৈরাগী’ নামে একটি গানের দলও করেছিলেন তিনি। হাশিম মাহমুদের শিল্পকর্মের নানান জায়গায় ব্যবহার নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে পরিবারের লোকজনের। হাশিম মাহমুদের লেখা অনেক গান বিনা অনুমতিতে অনেকে ব্যবহার করেছে বলে দাবি তাদের। ন্যূনতম সম্মানীও তাকে দেয়া হয়নি। অনেকেই আবার নামমাত্র সম্মানি দিয়ে লেখা ব্যবহার করেছেন। তবে যশ বা টাকা-পয়সা নিয়ে কখনো মাথা ঘামাননি তিনি।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, মানসিক সমস্যার পাশাপাশি শারীরিকভাবেও অসুস্থ এই শিল্পী। তিন বছর আগে চিকিৎসা করানো হয়েছিল।

তার বোন দিলারা মাসুদ ময়না বলেন, ‘হঠাৎ ভালো থাকেন আবার হঠাৎ রেগে যান। তখন সবাইকে ঘর থেকে বের করে দেন। টিভিতে পরিচিত কোনো সুর শুনলে তার গান চুরি করেছে বলে হৈ-চৈ করেন। নিজের ভেতরে ভেতরে আলাদা জগত তৈরি করেছে। গত ঈদেও সব ভাই-বোন একত্রে বসে গান করেছি। এখন আর ঘর থেকে বের হতে চান না।’

‘ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে একবার গান গাইতে গাইতে তার গলা জ্বলছিল। এরপরেও গানের অনুরোধ আসছিল। এত লোকের মাঝে মুগ্ধকণ্ঠে টানা ১৪টা গান গেয়েছেন। সেদিন তাকে টাকার মালা পরানো হয়েছিল।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ছোট বোন ময়না।

হাশিম মাহমুদের বৃদ্ধা মা জমিলা বলেন, ‘এক মেয়ের সাথে লালন ফকিরের আখড়ায় গিয়েছিল। ওই মেয়েরে বিয়ে করার কথা ছিল। সেই মেয়ের সাথে আর বিয়ে হয়নি। এরপরেই আরো আউলাইয়া গেছে।’

নীরবে-নিভৃতে কালের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘হাওয়া’ সিনেমায় চলচ্চিত্র নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন তার গানটি নেন। গানটিতে তার কণ্ঠ দেয়ার কথা থাকলেও শারীরিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দিতে পারেননি। হাশিম মাহমুদের সুর ও কথার এ গানে কণ্ঠ দিয়েছেন এরফান মৃধা শিবলু। এর আগে হাশিম মাহমুদের কণ্ঠে ‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি’ গানটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল।

 


আরো সংবাদ



premium cement