বিপরীতমুখী ঋণগ্রহীতারা
- আশরাফুল ইসলাম
- ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০
ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে তা বিতরণ করে ঋণগ্রহীতাদের কাছে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের অর্থ সুদে আসলে পরিশোধ করতে হয়। আবার ঋণগ্রহীতের কাছ থেকে আদায় করা হয়। অর্থাৎ প্রথমে ব্যাংক গ্রহণ করে তা বিতরণ করে। পরে আবার প্রদান করে ও গ্রহণ করে। এভাবেই দেয়া এবং নেয়ার মাঝে যে পার্থক্য থাকে তাই হলো ব্যাংকের মুনাফা। এ দিক থেকে দেখা যায়, ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোক্তার মাঝে ঋণ বিতরণ করে নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন করে। এর মাধ্যমে ভোক্তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করে। আবার নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আবার আমানতকারীদের মুনাফা দিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ শিল্পোদ্যোক্তা আমানতকারীদের আমানতের অর্থ নিয়ে পণ্য উৎপাদন করে। আর আমানতকারী ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে মুনাফা নিয়ে উদ্যোক্তার উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করে। এতে উদ্যোক্তা তার উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে মুনাফা করে। আর এ মুনাফা দিয়েই তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। এভাবেই ব্যাংক ক্রেতা ও উদ্যোক্তার মাঝে সেতু বন্ধন তৈরি করে।
আলোচনার শুরুতেই যে হিসাব-নিকাশের অবতারণা করা হলো, তাতে এটাই স্পষ্ট, উদ্যোক্তার স্বার্থেই তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এখন কেউ ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে তার পণ্যের বাজারজাত করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেতার অভাব দেখা দেবে। ফলে উদ্যোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বর্তমান ব্যাংকিং খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না এক শ্রেণীর উদ্যোক্তা। ঋণ পরিশোধ না করার মিছিল দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে না, বরং তা প্রসারিত হচ্ছে। অর্থাৎ ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।
ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেননি প্রায় চার হাজার ৬০০ ঋণখেলাপি ও তাদের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংকগুলো অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। এতে ব্যাংকের নগদ আদায়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সম্প্রতি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান, তাদের খেলাপি ঋণ ও আদায়ের পরস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, যা জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮ হাজার ২৪০টি ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আলোচ্য ঋণখেলাপিদের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার হাজার ৫৬৮টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হওয়ার পর থেকে এক টাকাও পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের কাছেই আটকা রয়েছে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে এক হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, বহুল আলোচিত ক্রিসেন্ট লেদারের কাছে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিট লেদারের কাছে এক হাজার ২৩৯ কোটি টাকা, লেক্সো লিমিটেডের কাছে ৫১৪ কোটি টাকা, বেল কনস্ট্রাকশনের কাছে প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা, জ্যাকওয়্যার্ড নিটওয়্যার লিমিটেডের কাছে ৪৪১ কোটি টাকা, শাহরিশ কম্পোজিট টাওয়ালের কাছে ৩১৪ কোটি টাকা, এসকে স্টিলের কাছে ২৭১ কোটি টাকা, হেল্পলাইন রিসোর্স লিমিটেডের কাছে ২৫৮ কোটি টাকা, নূরানী ডাইং অ্যান্ড সুয়েটারের কাছে ২৫০ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। ঋণ পরিশোধ না করার এ প্রবণতা কেন বাড়ছে? এর উত্তর খুঁজতে আমাদেরকে তাকাতে হবে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছেন তার সঠিক ব্যবহার করছেন কি না। আগেই বলা হয়েছে, উদ্যোক্তার স্বার্থেই তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণে শিল্পকারখানা স্থাপন না করলে তার পণ্য বাজারজাত করার কোনো প্রশ্নই থাকে না। অর্থাৎ নতুন নতুন কারখানা স্থাপন না করলে তার পণ্যও বিক্রির ঝামেলা থাকে না। তাহলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তা শিল্পকারখানা স্থাপন না করলে ওই ঋণ কী কাজে ব্যবহার করেন। এর উত্তরে বলা হয়, একজন উদ্যোক্তা শিল্পকারখানা স্থাপনের নামে ঋণ নিয়ে তা স্থাপন না করলে হয় ওই ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেন, আর না হয় অন্য অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেন। ঋণের অর্থ দু’টির যেকোনো খাতেই ব্যয় করা হোক না কেন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংক, আমানতকারীসহ অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক।
দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে, এটা আমরা নানা সময়ে দেশী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন থেকে দেখতে পাই। মার্কিন গবেষণা সংস্থাসহ আরো কয়েকটি সংস্থা থেকে প্রতি বছরই এ বিষয়ে তথ্য দেয়া হয়। তথ্য প্রকাশের পর কিছু দিন হইচই করা হয়। এর পর অন্য ঘটনার মতো টাকা পাচারের গর্হিত অপরাধের আলোচনাও থেমে যায়। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) তথ্য বলেছে, গত ১০ বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু গত ২০১৫ সালেই পাচার হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারটি প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসা।
প্রতি বছরই টাকা পাচারের তথ্য নিয়ে দেশীয় বিভিন্ন সংস্থা কিছু দিন কথাবার্তা বললেও পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারের তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। কারা টাকা পাচার করছেন, কেন করছেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করার কী পদক্ষেপ নেয়া যায়, সে বিষয়ে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
কেন পাচার করা হয় এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলছেন, জাতীয় জীবনের নিরাপত্তা যখন অনিশ্চিত হয় তখন দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পান বিনিয়োগকারীরা। আস্থার সঙ্কটে ভোগেন তারা। আর এ কারণেই তাদের মূলধন বিদেশে নিয়ে যান অনৈতিক পন্থায়। গত কয়েক বছরে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়াও একটি অন্যতম কারণ বলে কেউ কেউ মনে করেন।
দেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার অর্থই হলো দেশকে বঞ্চিত করা। কেননা, যে টাকা পাচার হচ্ছে, ওই টাকা দেশে বিনিয়োগ করলে কর্মসংস্থান বাড়ত। এসব বিনিয়োগ থেকে উৎপাদিত পণ্য দিয়ে বর্ধিত হারে দেশের চাহিদা মেটানো যেত। কিন্তু টাকা পাচার হয়ে যাওয়ায় এখন ওই হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে না কর্মসংস্থানের। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখতে হলে জাতীয় উৎপাদনে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৭ থেকে ২৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হতে হবে। কয়েক বছর ধরে তা ২১ শতাংশের ওপরে যাচ্ছে না। টাকা পাচার থামাতে না পারলে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না। বর্ধিত হারে সৃষ্টি হবে না কর্মসংস্থানের।