২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঋণখেলাপিদের আটকাতে আইনি কাঠামো

-

ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যিনি ফেরত দেননা তাদেরকে ব্যাংকের ভাষায় ঋণখেলাপি বলা হয়। ব্যাংক সবসময় একজন ভালো গ্রাহককে যেমন সমীহ করে চলে, তেমনি মন্দ গ্রাহককেও অনেক সময় সমীহ করা হয়। মন্দ গ্রাহককে নানাভাবে বুঝিয়ে ব্যাংকের টাকা ফেরত দিতে উৎসাহিত করা হয়। পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখন সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়। এতে বাধ্য না হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে টাকা আদায় করা হয়। ঋণখেলাপিদের আটকাতেও ব্যাংক কোম্পানি আইনে নানা ধারা রয়েছে। এসব ধারা বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকগুলোর মুরব্বি বলে খ্যাত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও সময়ে সময়ে সাকুলার জারি করে। কিন্তু কোনো কিছুই আটকাতে পারে না অসাধু ঋণখেলাপিদের। তারা বিকল্প পন্থা বের করে জনগণের কষ্টের আমানত বছরের পর বছর আটকে রাখেন। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান না নিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোকে তাই দেউলিয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারও জনগণের কষ্টের করের অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দেয়া হয়। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সারা বছর যে মুনাফা করে তার একটি অংশ প্রভিশন রেখে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সম্পদ সংরক্ষণ করে থাকে।
এখন দেখা যাক, ঋণখেলাপিদের আটকাতে আইনি কাঠামোতে কি আছে। ব্যাংকিং খাত থেকে খেলাপিঋণ দূরীভূত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৩ সালে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে এবং নতুন করে কেউ ঋণ খেলাপি না হন সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক দু’টি পদ্ধতি গ্রহণ করে। এ দু’টি পদক্ষেপ ছিল আইনগত পদক্ষেপ এবং পদ্ধতিগত পদক্ষেপ। আইনগত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয় ব্যাংক কোম্পানি আইন ও গণপ্রতিনিধত্ব আদেশ ১৯৭২ এর মাধ্যমে। আর পদ্ধতিগত হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত মনিটরিং করা। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে খেলাপি ঋণ পরীবিক্ষণ করে এবং ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজন মোতাবেক নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
আইনগত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯৩কে সংশোধনী করে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৭ ধারা মোতাবেক কোনো ঋণখেলাপিকে নতুন করে ঋণ দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোন ব্যাংক থেকে কি পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, ঋণ নিয়ে ঠিক মতো পরিশোধ করা হয়েছে কি না, অথবা গ্রাহক খেলাপি কি না তার তথ্য মজুদ করে রাখে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য মোতাবেক গ্রাহক যদি ঋণ খেলাপি হয়ে থাকে তাহলে তাকে ঋণ প্রদান থেকে বিরত থাকে।
অপরদিকে গণপ্রতিনীধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর মতে জাতীয় নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে নির্বাচনের সময় সম্ভাব্য প্রার্থী ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে। অনেকে একটি নির্ধারিত পরিমান অর্থ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়ন করেন।
এ কারণে কোনো ব্যাংক গ্রাহককে ঋণ দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ঋণ খেলাপি কি না তার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে যাচাই বাছাই করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্রাহকদের ঋণ তথ্য দিয়ে ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে থাকে।
৫০ হাজার টাকার ওপরে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন এমন গ্রহাকের ঋণতথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সাধারণত প্রতি মাসে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এক কোটি টাকা বা এর ওপরে ঋণ গ্রহীতাদের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি সংগ্রহ করে। আর ৫০ হাজার টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাদের তথ্য প্রতি তিন মাস অন্তর সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এরকম প্রায় কোটি খানেক ঋণগ্রহীতার তথ্য মজুদ রয়েছে। আগে ব্যাংকগুলো ঋণতথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসত। এখন সিআইবি অনলাইন হওয়ায় ব্যাংক ঘরে বসেই ঋণখেলাপির তথ্য যাচাই-বাছাই করেন।
কিন্তু এতোসব পদক্ষেপ অসাধু ঋণখেলাপিদেরকে আটকাতে পারছে না। বিকল্প পদ্ধতিতে পার পেয়ে যাচ্ছেন এসব ঋণখেলাপিরা। ব্যাংকারদের যোগ সাজসে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ সমন্বয় করার পাশাপাশি খেলাপিরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তারা আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম স্থাগিত করিয়ে নিচ্ছেন। এ সুবাদে তারা ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নিয়মাচারকে পাশ কাটিয়ে অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগ নিচ্ছেন। শুধু এটিই নয়, বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধের দায় থেকেও তারা নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। জানামতে, এভাবে প্রায় হাজার খানেক বড় ঋণখেলাপি আছেন যারা ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া থেকে অব্যহতি পেয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রাতহবিল আইএমএফের এক প্রতিবেদন অনুসারে ৬৭৫ জন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতার আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিত আদেশ দেন আদালত। ফলে ঋণখেলাপির হিসাবে দেখায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ। অর্থাৎ আদালতের স্থগিত আদেশে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বড় বড় ঋণখেলাপিরা এখন উচ্চ আদালতে রিট করে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে সমায়িক সময়ের জন্য স্থাগিতাদেশ নিচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়ছে না, বরং ক্ষেত্র বিশেষ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার ওই একই ব্যক্তি অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এমনও অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের উচ্চ আদালতে যেতে প্ররোচিত করছেন। ওই সূত্র জানিয়েছে, ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ঋণ সমন্বয় করা হচ্ছে অহরহ। যে ব্যাংকেই তদন্ত করা হচ্ছে ওই ব্যাংকেই এমন অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনের পর সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখন উদ্বেগের বিষয় হলো, গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্বেগ প্রকাশ করে খেলাপিদের আটকাতে বিকল্প পদ্ধতি বের করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
এরপরেও নানা পন্থায় ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। ২০১৫ সালে ঋণপুনর্গঠনের নামে মাত্র ১ ও ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়। আবার চলতি বছর থেকে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ১০ বছরের জন্য ঋণ নবায়ন করা হচ্ছে। তাদের সুদহারেও ছাড় দেয়া হচ্ছে। এখানেও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আড়াল হয়ে যেতে পারে বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন।
ব্যাংকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা, ঋণখেলাপিদের ঘন ঘন ছাড় দেয়ার ফলে তাদের নগদ আদায় কমে গেছে। বিশেষ করে তৈরী পোশাক খাত, টেক্সটাইল, আবাসনখাতসহ বেশ কয়েকটি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার অনেকেই ইচ্ছেকৃতভাবে ঋণখেলঅপি হয়ে যাচ্ছেন বিশেষ সুবিধা নেয়ার জন্য। এতে ব্যাংকের তহবিলেও টান পড়েছে। নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কমে যাচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকের ঝুঁকির পরিমাণ। একদিকে, ব্যাংকের বেতনভাতাসহ ইউটিলিটি বিল বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে কমছে আয়। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement