২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রাইভেট সেক্টরের অস্থিরতা

-

কর্মসংস্থানের সাথে সরাসরি জড়িত সামাজিক স্থিতিশীলতা। একটি দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে ওই দেশের সুষম কর্মসংস্থানের ওপর। সরকার একা একটি দেশের নাগরিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। এ জন্য বেসরকারি খাতের দরকার হয়। বর্তমান বিশ্বে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতের অবদানই বেশি। তবে সরকারের সহায়তার ওপর ভর করেই বেসরকারি খাত সম্প্রসারিত হয়। সরকারের সহায়তা ছাড়া বেসরকারি খাত এগুতে পারে না।
এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। আর এ নতুন মুখের জন্য দরকার নতুন কর্মসংস্থান। বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন নতুন শিল্পকারখানা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নানা কারণে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। বিনিয়োগ কমার অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, ও সর্বোপরি বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কায় নতুন বিনিয়োগ করতে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। তাদের মতে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বছর শেষে জাতীয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
দীর্ঘ দিন ধরে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কম হচ্ছে। কমে গেছে, পণ্য আমদানির জন্য সামগ্রিক এলসি খোলার হার। এলসি খোলার হার কমে যাওয়ার অর্থ হলো সামনে শিল্প বিনিয়োগ কমে যাবে। অর্থাৎ নতুন নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে। কর্মসংস্থান কমে যাবে। বাড়বে বেকারত্বের হার। এতে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাবে। তাদের মতে, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি প্রবৃদ্ধির কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে কর্মসংস্থানসহ সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। প্রথমত, গ্যাস সংযোগ দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাব নতুন নতুন শিল্পকারখানা আসছে না। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানিমুখী পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ার কারণে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর সামগ্রিক প্রভাবে রফতানি কমছে। এটা অব্যাহত থাকলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ দিকে দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ নতুন মুখ যোগ হচ্ছে। বর্ধিত হারে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারলে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। এ কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য উৎপাদনমুখী বিনিয়োগের আকৃষ্ট করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে নতুন শ্রুমবাজারের সন্ধান করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের কাজের বিনিময়ে কর্মসংস্থানসহ কর্মসংস্থানমুখী কর্মসূচি আরো বাড়াতে হবে। অন্যথায় অস্থিরতা বেড়ে যাবে।
ব্যবসায়ীদের মতে, গ্যাসস্বল্পতাই বর্র্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কারণ, সরকার নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না। আবার অবকাঠামো সুবিধাও বাড়ছে না। এর প্রভাবে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কমে যাবে কর্মসংস্থান। প্রতি বছর লাখ লাখ নতুন মুখ আসছে শ্রমবাজারে। বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারলে বেকার জনসংখ্যা সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির কমে যাবে এটাই বাস্তবতা। কেননা, সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেবে না, বিদ্যুৎ সংযোগের জটিলতা, উচ্চ ঋণের সুদ, দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোতে নতুন বিনিয়োগ হবে না এটাই স্বাভাবিক। নতুন গ্যাস সংযোগ না দিলে উদ্যোক্তারা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে করে কী করবে। অপর দিকে বর্তমানে ঋণের উচ্চ সুদের কারণে নতুন করে উদ্যোক্তারা সাহস পাচ্ছে না। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। কমে যাচ্ছে বিদেশী বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা। এ পরিস্থিতি রফতানি আয়ও কমতে শুরু করেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সাধারণের আমানতের অর্থ দিয়ে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু ঋণের বড় একটি অংশই আদায় হচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ আমানতকারীদের মেয়াদ শেষে সুদে আসলে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে নগদ টাকার প্রবাহের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। এর ওপর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে। সব মিলেই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে চলে যাচ্ছে।
এ দিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে চলছে। ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়া। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আগস্টে রাজস্ব আদায় ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। গত বছরের আগস্টে যেখানে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা, চলতি বছরের আগস্টে তা কমে নেমেছে ১৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা সেখানে গত আগস্টে না বেড়ে বরং রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এ দিকে গত অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের বড় অবদান রেখেছিল সঞ্চয়পত্র। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। যেমন, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার নিট ঋণ পেয়েছে ৩ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমে গেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। বিনিয়োগকারীদের ওপর নানা ধরনের করারোপ ও কড়াকড়ি করায় সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। এ কারণেই ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ বেড়ে গেছে। ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর চাপ বেড়ে গেছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণ আদায় হচ্ছে না। বিশেষ করে কিছু বড় বড় শিল্প গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু তারা নানা উপায়ে তা পরিশোধ না করে নিয়মিত দেখাচ্ছেন। আবার অনেক বড় ঋণগ্রহীতা ঋণ নিয়মিতও করছেন না। আবার কেউ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে ঋণখেলাপির ওপর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। আইএমএফের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খেলাপি, ঋণ নবায়ন ও উচ্চ আদালতে রিটসহ প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকায় উঠেছে। খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে। এ দিকে আমানতকারীদের মেয়াদ শেষে সুদে আসলে অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে। সব মিলেই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার প্রবাহের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। নগদ টাকার চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারছে না। অনেক ব্যাংকই ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ সর্বনি¤œ অবস্থায় চলে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে গেছে, যা এ যাবৎকালে সর্বনি¤œ বলে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাওয়ায় আয় কমে যাচ্ছে। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা, ভবন ভাড়া, ইউটিলিটি বিলসহ সামগ্রিক ব্যয় কমছে না বরং বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সামনে ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। অনেক ব্যাংকেরই লোকসানের ধকল কাটানো সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তারা।

 


আরো সংবাদ



premium cement