কমছে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয়
- লাবিদ ইসলাম
- ০৬ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
কোনো ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় কমে যাওয়ার অর্থই হলো শেয়ারের মূল্য আয়ের অনুপাত (প্রাইজ আর্নিং রেশিও বা পিইআর) কমে যাওয়া। আর কোনো কোম্পানির পিইআর কমে যাওয়ার অর্থ হলো বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন, কোনো বিনিয়োগকারীর একটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগ তুলতে যেখানে পাঁচ বছর সময় লাগত, সেখানে ১০ বছর লেগে যাবে বিনিয়োগ তুলতে। মোট কথা শেয়ারপ্রতি আয় কমে যাওয়ার অর্থই হলো শেয়ারটি মৌলভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ২৭ ব্যাংকের মধ্যে ১৮টিরই শেয়ারপ্রতি আয় কমে গেছে। ব্যাংকগুলোর তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই- সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তবে, সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শেয়ারপ্রতি আয়ের তিন মাসের প্রতিবেদনটি অনিরীক্ষিত হিসাব। বাস্তবে ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। শেয়ারপ্রতি আয় কমে যাওয়ায় মূল্য আয়ের অনুপাত কমে যাচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয়ের অনিরীক্ষিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ঢাকা স্টক এক্সেচেঞ্জে এ পর্যন্ত ২৭টি ব্যাংক তাদের আয়ের প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় ১৮টিরই শেয়ারপ্রতি আয় কমে গেছে আগের বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায়। আর ৯টির আয় বেড়েছে। শেয়ারপ্রতি আয় কমে যাওয়া ব্যাংকগুলোর তালিকায় রয়েছে আল আরাফা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সিটি ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ও উত্তরা ব্যাংকের।
যেমন, গত গত তৃতীয় প্রান্তিকে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৩৫ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪০ পয়সা। ইসলামী ব্যাংকের গত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ১৪ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ২৬ পয়সা। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ২৭ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই প্রান্তিকে মুনাফা হয়েছিল ৩০ পয়সা। ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৭০ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই প্রান্তিকে আয় হয়েছিল ১ টাকা ৬ পয়সা।
শেয়ারপ্রতি আয় কমে গেছে দি সিটি ব্যাংকের। ব্যাংকটির গত প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে ৭৬ পয়সা। আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৮৫ পয়সা। ইস্টার্ন ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় কমে নেমেছে ৮৮ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই প্রান্তিকে ছিল ৯২ পয়সা। তেমনিভাবে সাউথইস্ট ব্যাংকের ৭৬ পয়সা থেকে কমে ৫৮ পয়সা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ৬৬ পয়সা থেকে কমে ৫৭ পয়সা, ওয়ান ব্যাংকের ৩৫ পয়সা থেকে কমে ২২ পয়সা, প্রাইম ব্যাংকের ৪৫ পয়সা থেকে কমে ৪৪ পয়সা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৬ পয়সা থেকে কমে ২৯ পয়সা এবং উত্তরা ব্যাংকের ১ টাকা ২১ পয়সা থেকে কমে ৬২ পয়সায় নেমেছে গত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয়।
অপর দিকে আগের বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের চেয়ে এবার তৃতীয় প্রান্তিকে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়েছে এক্সিম ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকের। এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংকের গত তৃতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১২ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই প্রান্তিকে এ লোকসান ছিল ২ পয়সা। আর রূপালী ব্যাংকের গত প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৬৭ টাকা ৮ পয়সা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ২৯ টাকা ৯১ পয়সা।
একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয় কমে যাওয়ার অর্থই হলো ব্যাংকের সামগ্রিক আয় কমে যাওয়া। কারণ, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ থেকে আয় অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে। কারণ, ব্যাংকগুলো একটি নির্ধারিত হারে আমানত সংগ্রহ করে তা গ্রাহকদের কাছে বিনিয়োগ করে থাকে। কিন্তু বিতরণকৃত ঋণ আদায় না হলে সুদাসলে পুরো অর্থই আটকে যায়। পাশাপাশি নির্ধারিত মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের আমানত সুদাসলে ফেরত দিতে হয়। ওই এমডি জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে বেশির ভাগ ঋণই এখন বড় বড় রাঘববোয়ালদের কব্জায় চলে যাচ্ছে। শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ আকারে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু তা আর ফেরত দেয়া হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাহাড় সমান হয়েছে। দীর্ঘ দিন ঋণ পরিশোধ না করায় ওই ঋণ এখন কুঋণ বা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়ে গেছে।
প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে। এভাবে খেলাপি ঋণের বোঝা বহন করতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে যাচ্ছে। আর আয় কমে যাওয়ায় শেয়ারপ্রতি আয়ও কমে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এসব অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে আসত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তেমন পদক্ষেপ না নেয়ায় বছরের পর বছর এ অর্থ ব্যাংকের খাতায় খেলাপি ঋণ হিসেবে পড়ে থাকছে। মাঝে মধ্যে কৃত্রিমভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সে চেষ্টাও সফল হচ্ছে না। এতে ব্যাংকিং খাতের আকাশে কালো মেঘের ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। এটা বেশি দিন চলতে থাকলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।