২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দুঃসময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানি

-

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে তিন শতাধিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। এই তালিকায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে রয়েছে বিদেশী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও। নতুন বিনিয়োগ, বিশ্ব মর্যাদা অর্জন, গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি, বিশ্বস্ততা প্রমাণ, স্বচ্ছতা জানান দেয়া ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিগুলো। এজন্য নিজেদের মুনাফার অংশের ভাগও দেন বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু সেই কোম্পানির দুঃসময়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসির ইতিবাচক কোনো ভূমিকা দেখা যায় না।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় প্রকৌশল খাতের একটি কোম্পানি। কোম্পানিটি নতুন বিনিয়োগে যায়। এজন্য কারখানা সম্প্রসারণও করে। কিন্তু বিদ্যুতের একটি ভুল সংযোগ প্রতিষ্ঠানটিকে বড় ধরনের সমস্যায় ফেলে দেয়। উচ্চ ক্ষমতা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম ভোল্টেজের ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতের সংযোগ পায় তারা। এই বিদ্যুৎ ব্যবহারে কোম্পানির প্রয়োজন মিটছিল না। এমনকি বিদ্যুতের ইউনিট বেশি ব্যবহার হওয়ায়, সেই হারে বিলও বেশি আসছিল। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। এ নিয়ে মালিকানায়ও সমস্যা বাধে। পরে মালিকানায় হাতবদল পর্যন্ত হয়। নতুন মালিকানার নেতৃত্বে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানেও বিদ্যুতের বিষয়টি উঠে আসে। কোম্পানির পক্ষ থেকে বিদ্যুতের সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করা হয়। কোম্পানির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বিদ্যুতের লাইনটি বাণিজ্যিক ও অপেক্ষাকৃত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ভোল্টেজের সাথে সংযোগ করে দিতে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে এ নিয়ে গড়িমসি করা হয়। তারা কোনো মতেই সংযোগ পরিবর্তনে রাজি হয়নি। মন্ত্রণালয়ে গিয়েও লাভ হয়নি কোম্পানির। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে আবেদন জানানো হয়। আবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি যেন বিদ্যুৎ বিভাগে এ বিষয়ে সুপারিশ করে কোম্পানির পক্ষে।
কিন্তু কমিশনের সেই আইনি সুযোগ নেই বলে জানানো হয়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় কোনো সুবিধা পায়নি কোম্পানিটি। এভাবেই সময় পার হয়ে যায় কয়েক বছর। কোম্পানিও বর্ধিত খরচে পণ্য উৎপাদন করে। একসময় কিছু দিন বন্ধও রাখা হয় উৎপাদন। অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একাধিক তদ্বির ও অর্থ খরচের পরে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুতের সংযোগ পায় কোম্পানিটি। তখন কোম্পানির পরিচালকরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, কোম্পানির খবরদারিতে থাকলেও কোনো উপকারে আসতে পারে না বিএসইসি।
আবার সম্প্রতি চরম দুঃসময়ে পড়েছে টেলিকম খাতের কোম্পানি গ্রামীণফোন। টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির সাথে ভ্যাট ও কর নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারের এক মন্ত্রী পর্যন্ত উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন সমাধানে। এই বিবাদে সর্বশেষ গ্রামীণফোনের মূল কোম্পানি এশিয়া টেলিনর বাংলাদেশকে উকিল নোটিশ পর্যন্ত দিয়েছে। এখানে সমাধান না হলে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাবে বহুজাতিক কোম্পানিটি।
বিনিয়োগসংক্রান্ত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সবাই দ্বারস্থ হয় বিশ্বব্যাংকের স্বীকৃত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউটস (ইকসিড)। বাংলাদেশকেও সেই ফোরামে নিয়ে যেতে পারে বহুজাতিক এ কোম্পানিটির মূল কোম্পানি বলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত কোনো সদস্য রাষ্ট্র অবমাননা করেনি। বাংলাদেশও ইকসিডের সদস্য রাষ্ট্র।
কিন্তু এই টানা-হেঁচড়া ও দ্বন্দ্বে প্রতিনিয়ত কমছে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দর। কমছে কোম্পানিটির বাজার মূলধন। এক সময়ে থাকা ৬৩ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন থেকে এখন নেমে এসেছে ৩৯ হাজার কোটি টাকায়। এই মূলধন হারিয়েছে এ শেয়ারে বিনিয়োগকারীরা। এখনও প্রতিনিয়ত নামছে শেয়ারটির দর। বিবাদ ও শেয়ার দরের প্রভাব শুধু গ্রামীণফোন কোম্পানিতেই সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বহুমাত্রিকভাবে দেশের পুঁজিবাজারের ওপর। মৌলভিত্তির কোম্পানি ও শেয়ার সংখ্যা বেশি হওয়ায় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট বাজার মূলধনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে গ্রামীণফোনের। তাই এ কোম্পানির শেয়ার দরে ওঠা-নামা পুরো বাজারকে প্রভাবিত করে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা যাচ্ছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে।
অপর দিকে, বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও এই দ্বন্দ্বকে ভালো চোখে দেখছেন না। তারাও শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন লোকসান ঠেকাতে। আমাদের পুঁজিবাজারে একটি মিথ রয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে। তা হচ্ছে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও অনুসরণ করে। এতে সামগ্রিকভাবে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে ডিএসইর সূচক ও বাজার মূলধন। এই নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি কথাও বলেছেন, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান পর্যন্ত।
বিনিয়োগকারীদের দাবি হচ্ছে, কমিশনও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোরও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এক প্রকার। এজন্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির সুযোগ, সুবিধা ও বিপদে পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন বিএসইসির। সাধারণ বিনিয়োগকারী ও দেশের মর্যাদা রক্ষায় বিএসইসি স্ব-উদ্যোগেই এগিয়ে আসতে পারে দ্বন্দ্ব নিরসনে। বিষয়টির আইনি সমাধানে না গিয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করার সুযোগ আছে কমিশনের। বিএসইসির বিশেষ ক্ষমতাবলেও (টু সিসি ধারা) এটি সম্ভব।
বিশেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজার ও কোম্পানির ওপর প্রভাব ফেলবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত বা সমস্যার উদ্ভব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিকে তাকিয়ে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। প্রয়োজনে একটি বিভাগ বা সেলও খুলতে পারে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে সমন্বয় করতে। বর্তমানে খাত ভেদে কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা একাধিক। এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের দাবি দীর্ঘ দিনের। বর্তমান ইস্যুও তৈরি হয়েছে সমন্বয়হীনতার অভাবে।
বিএসইসি এগিয়ে এলে তালিকাভুক্ত কোম্পানি একটি অভিভাবক পাবে। রাষ্ট্রের অন্য সংস্থার কাছ থেকে দ্রুত সেবা পাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো। যার প্রভাব পড়বে দেশের পুঁজিবাজারে। সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে তালিকাভুক্ত অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানি ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের ওপর। সাধারণ বিনিয়োগকারী ও খাতসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের জানান, নতুন একটি উদাহরণ তৈরি করতে পারে বিএসইসি। সব নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিয়ে বৈঠক করতে পারে দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে। সেখানেই আলোচনার ভিত্তিতে নিরসন হতে পারে এ জাতীয় সমস্যার। দেশেই সমস্যার সমাধান হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এতে সময় ও রাষ্ট্রের অর্থের সাশ্রয় হবে। যার সুফল পাবে সব ধরনের বিনিয়োগকারী।


আরো সংবাদ



premium cement