ধারাবাহিকভাবে কমছে রফতানি আয়, বাড়ছে ঝুঁকি
- লাবিদ ইসলাম
- ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
শিল্পের বিকাশে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা আমদানি করি। এতে প্রয়োজন হয় বৈদেশিক মুদ্রা। আর এ বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান করি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের রফতানি ও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে যে টুকু বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়, পণ্য ও সেবা আমদানিতে ব্যয় হয় তার চেয়ে বেশি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মেটাতে আমরা বৈদেশিক ঋণ করি, বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে গ্রহণ করি বিভিন্ন অনুদান।
আমাদের আমদানি ব্যয়ের বড় একটি অংশের সংস্থান হয় রফতানি আয়ের মাধ্যমে। বিভিন্ন পণ্য রফতানির মাধ্যমে আমরা প্রতি বছর এ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি। কিন্তু রফতানির ঝুড়িতে পণ্যের পরিমাণ আশাব্যঞ্জক নয়। যে কয়েকটি পণ্য রয়েছে তার মধ্যে রফতানি আয়ে বেশির ভাগই দখল করে আছে তৈরী পোশাক খাতে। রফতানি আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। বাকি ১৫ শতাংশ আসে বাকি পণ্য থেকে। রফতানি আয়ে তৈরী পোশাক খাতের বিকল্প কোনো পণ্য আজো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের রফতানি খাত তৈরী পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রফতানির ঝুড়িতে তৈরী পোশাক খাতের বিকল্প কোনো পণ্য না আশায় তাই আমরা সব সময় থাকি উদ্বিগ্ন। এ খাতের ওপর হালকা কোনো ঝড় এলেই আমরা আতঙ্কিত হই, হই শঙ্কিত। নানা অজানা আশঙ্কা আমাদের ওপর ভর করে।
রফতানি আয়ের গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রতি বছর যে পরিমাণ রফতানি আয় হয়, তার গড়ে ৮০ শতাংশ আয় হয় ৈ ৈ তৈরী পোশাক খাত থেকে। যেমন, দেশে মোট রফতানি আয়ের ২০১০ সালে ৭৭ শতাংশ, ১১ সালে ৭৮ শতাংশ, ১২ সালে ৭৮ শতাংশ, ১৩ সালে ৭৯ শতাংশ, ১৪ ও ১৫ সালে ৮১ শতাংশ করে, ১৬ সালে ৮২ শতাংশ আয় হয় তৈরী পোশাক খাত থেকে। গত অর্থবছরে আয় হয় সাড়ে ৮৩ শতাংশ এবং গত অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৮৪ দশমিক ২২ শতাংশ আয় হয়েছে রফতানি খাত থেকে। অর্থাৎ তৈরী পোশাক খাতের রফতানি আয় বাড়লে আমাদের মোট রফতানি আয় বাড়ে, আর এ খাতের কোনো সমস্যা হলে সামগ্রিক রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চামড়া ও চামড়াজাত, পাট ও পাটজাত, হোম টেক্সটাইল ও প্রকৌশল পণ্যের মতো বড় খাতের রফতানি আয় কমে গেছে। ব্যতিক্রম কেবল তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য ও হিমায়িত খাদ্য।
রফতানি আয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের পঞ্চম মাস অর্থাৎ নভেম্বরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। আর আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে এই আয় ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, একক মাস হিসেবে নভেম্বরে রফতানি আয় হয়েছে ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার, কিন্তু টার্গেট ছিল ৩৭২ কোটি ২০ লাখ ডলার। অর্থাৎ টার্গেটের তুলনায় নভেম্বরে রফতানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। আর গত বছরের নভেম্বরে রফতানি আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ফলে একক মাস হিসেবে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৮০৫ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু, আয় হয়েছে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম।
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট রফতানি আয়ে পোশাকের অবদান প্রায় ৮৩ শতাংশ। তবে হোমটেক্স, টেরিটাওয়েলসহ এ খাতের অন্য পণ্যগুলোকে রফতানির উপ-খাত হিসাব করলে তৈরি পোশাক খাতের অবদান ৮৫ শতাংশে দাঁড়াবে। তাই তৈরি পোশাকের রফতানি কমলে তার প্রভাব পড়ে পুরো রফতানি খাতে। তৈরী পোশাক খাতের মালিকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কম। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন না করা ও অবকাঠামোগত সমস্যা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারসহ বিভিন্ন কারণে রফতানি আয় নি¤œœমুখী।
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পোশাক রফতানিতে আয় হয়েছে এক হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। এই সময়ে রফতানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের বড় খাতগুলোতেও রফতানি আয় কমেছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয় প্রবৃদ্ধি কমেছে। পাঁচ মাসে চামড়াজাত খাত থেকে রফতানি আয় এসেছে ৩৯ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ কম। প্রবৃদ্ধিও কমেছে ১০ দশমিক ০৩ শতাংশ। কৃষিপণ্য রফতানিতে আয় আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ কমে ৪৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার হয়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রফতানিতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। পাঁচ মাসে এ খাতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলার।
রফতানি খাতকে সুরক্ষিত রাখতে বিকল্প উপায় বের না হওয়া পর্যন্ত তৈরী পোশাক খাতকে ঠিক রাখার জন্য যত ধরনের সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন তা দিতে হবে। এ জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকে অচিরেই তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সাথে বসতে হবে। তাদের সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে কারখানাগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় তৈরী পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু অর্থনীতি প্রবৃদ্ধিই কমবে না, লাখ লাখ কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে, যা দেশের জন্য মোটেও শুখকর হবে না।