শিল্প উদ্যোক্তাদের নাভিশ্বাস
- লাবিদ ইসলাম
- ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০
শিল্প ঋণের মধ্যে বেশি খেলাপি পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করছেন বড় বড় উদ্যোক্তারা। এদের চেয়ে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বেশি হারে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করছেন। যেমন, মোট ৫৭ হাজার ২০১ কোটি টাকার শিল্প খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ৬৭ শতাংশই বড় উদ্যোক্তাদের দখলে। বাকি ২২ শতাংশ মাঝারি উদ্যোক্তা ও ১১ শতাংশ রয়েছে ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে।
শিল্পঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপরি উক্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এ খাতের সামগ্রিক চিত্র। ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ ও উচ্চ কর হারের কারণে ব্যবসায়ীরা ভালো করতে পারছে না। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে পড়ে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যবসায়বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ কারণে ব্যবসায়ীরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। আর সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করার কারণে ব্যাংকিং খাতে যেমন খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি অনেক শিল্প উদ্যোক্তা ব্যবসায়ে লোকসানের ধকল কাটিয়ে উঠতে না পেরে ব্যবসায়বাণিজ্য বন্ধ করে দিচ্ছেন। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। ঢাকা চেম্বারের সাবেক এক প্রেসিডেন্ট বলেন, শিল্প উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে তাদের বিনিয়োগকৃত মূলধনের। এজন্য তিন বছর বা পাঁচ বছরমেয়াদি কলহার অপরিবর্তিত রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ ইউটিলিটি বিলের নিশ্চয়তা। একজন শিল্প উদ্যোক্তা যদি আগে থেকেই জানতে পারবেন তার বিনিয়োগকৃত শিল্পে পাঁচ বছরে বাড়তি কোনো ট্যাক্স দিতে হবে না, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত থাকবে, তাহলে ওই উদ্যোক্তা কষ্টার্জিত মূলধন দিয়ে বিনিয়োগ করতে যেমন নিশ্চয়তা পাবেন, তেমনি তার বিনিয়োগ থেকে সৃষ্টি শিল্পকারখানাও লাভের মুখ দেখবে। এতে বাড়বে কর্মসংস্থান। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো ব্যবসায়ীদের উচ্চ হারে ট্যাক্স দিতে দিতে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য ঘন ঘন বৃদ্ধি পায়। ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যায় হরহামেশাই। ফলে ব্যবসায়ী ব্যয় বেড়ে যায়। এতে শিল্পকারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে ব্যবসায়ী প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। এতে লোকসানের সম্মুখীন হন। আর এ লোকসানের কারণেই ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ। অনেকেই ব্যবসায়বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। কেউবা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের ভয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের এ বহুমুখী সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
ব্যাংকারদের মতে, নতুন নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন কমে গেছে। ফলে যে পরিমাণ শিল্পঋণ বিতরণ করা হচ্ছে তার বেশির ভাগই চলতি মূলধন খাতে বিতরণ করা হচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন কমে যাওয়ায় কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। যেমন, গত অর্থবছর শেষে এ খাতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশির ভাগই চলতি মূলধন খাতে বিতরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত অর্থবছর শেষে চলতি মূলধন খাতে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই চলতি মূলধন খাতের ঋণ। আর বাকি ২০ শতাংশ ঋণ হলো মেয়াদি ঋণ।
ব্যাংকিং খাতে এখন বড় সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির জন্য। কারণ, তাদের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী প্রকৃতপক্ষে ব্যবসা মন্দাজনিত কারণে ঋণখেলাপি হওয়ার চেয়ে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা অনেক বেশি। আর এর অন্যতম কারণ হলো ঘন ঘন ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য বিদ্যমান নীতিমালা শিথিল করা। ঋণখেলাপিদের ডাউন পেমেন্টে ছাড়, সুদহারে ছাড় দেয়ার কারণে সুবিধা পাওয়ার জন্য অনেকেই নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছেন না। সর্বশেষ মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়ায় যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তাদের অনেকেই এ সুবিধা নেয়ার জন্য ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় ছিল কেউ প্রথমবার খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে হলে ১৫ শতাংশ নগদে ঋণ পরিশোধ করতে হবে, আর একাধিকবার ঋণ নবায়ন করতে হলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নগদে পরিশোধ করতে হবে। এ নীতিমালায় বাংলাদেশ ব্যাংক অটল থাকলে ঋণখেলাপিদের সংখ্যা যেমন কমতো, তেমনি ঋণ আদায়ও স্বাভাবিক থাকত। ঘন ঘন নীতিমালা শিথিল করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণের পাহাড় হওয়ার কারণে কষ্ট করে যেটুকু মুনাফা করা হচ্ছে তার একটি বড় অংশই খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর নতুন করে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।