খেলাপি ঋণ : আইএমএফের প্রতিবেদন
- আশরাফুল ইসলাম
- ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
খেলাপি ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি। এর প্রভাবে কমছে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ আসলে কত এ নিয়ে নানাজনের নানা মন্তব্য আছে। ব্যাংকগুলোর মুরুব্বি বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হলো এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এ চিত্রের সাথে এক মত নন দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। কিন্তু কত বেশি সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য কেউ দিতে পারেননি। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিবেদন অনুসারে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দ্বিগুণেরও বেশি। তাদের প্রতিবেদন অনুসারে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। এসবের মধ্যে আদালতের স্থগিত আদেশ, পুনঃতফসিল এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের ঋণও রয়েছে। এই পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক, যা সাতটি পদ্মা সেতুর ব্যয়ের সমান।
আইএমএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, খেলাপি ঋণ আসলে দ্বিগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংক ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকার হিসাব দেখায়। কিন্তু আদালতের স্থগিত আদেশে ৭৯ হাজার ২৪২ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। ৬৭৫ জন শীর্ষ ঋণ গ্রহীতার আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিত আদেশ দেন আদালত। ফলে ঋণখেলাপির হিসাবে দেখায় না বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া বিভিন্ন কারণ এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ২১ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এগুলোও খেলাপি ঋণের মধ্যে পড়ে। বিশেষ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ১৯২ কোটি টাকা।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ৯ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দুই লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঋণের ২৬ শতাংশ খেলাপি। আবার জাতীয় বাজেট পাঁচ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ জাতীয় বাজেটের প্রায় অর্ধেক খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ কমানো সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ৪৩টি সুপারিশ করেছে আইএমএফ। এর মধ্যে ঋণ নীতিমালায় পরিবর্তন, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং ব্যাংকের পর্ষদের রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধের সুপারিশ করা হয়।
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি টানা তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ছয় মাস পরিশোধ না করলে সন্দেহজনক ও ৯ মাস কিস্তি বকেয়া পড়লে সে ঋণকে মন্দমানের খেলাপি হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়। শ্রেণীকৃত এ ঋণই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। কোনো গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। গ্রাহককে সুবিধা দিতেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এমন গ্রুপগুলোকে তা পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়া হয়। খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত এ ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৮ সালে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। একই বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর সাথে বিদায়ী বছরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে ২০১৮ সাল শেষেও দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ২২ শতাংশের বেশি দাঁড়ায়।
সংশিষ্টদের মতে, ব্যালান্সশিট পরিচ্ছন্ন দেখাতে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করছে। আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলের সুযোগ না থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রভাবশালী গ্রাহকরা ১০ বারেরও বেশি পুনঃতফসিল সুবিধাও নিয়েছেন। তার পরও সে ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণের হার বেড়ে গেছে। এখন নতুন করে মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়েছে।
খেলাপি ঋণের বেশির ভাগই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি। তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা জানে ঋণ নিলে ফেরত দিতে হবে না। তাদের কালো টাকা এবং শক্তি দিয়ে বছরের পর বছর আইনি প্রক্রিয়া এড়াতে সক্ষম। তিনি বলেন, অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে খেলাপিদের ধরা সম্ভব নয়, এটা এক ধরনের প্রতারণা।
সরকার যদি সত্যি সত্যি তাদের শাস্তি দিতে চায়, তাহলে শীর্ষ খেলাপিদের বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারে। না হলে খেলাপিদের ধরা সম্ভব নয়। ঋণদাতা ও গ্রহীতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। অবসরে যাওয়া এসব এমডির কার আমলে কত ঋণ, কীভাবে গেছে, কার কাছে গেছেÑ তা খতিয়ে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ওই সব এমডিরাও ঋণের নামে অর্থলুণ্ঠন করেছেন।
খেলাপি ঋণের কারণে গোটা অর্থনীতি আসলে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়লেও ঋণগ্রহীতার যে কোনো বিপদ নেই, তা ভাবার কারণ নেই। ঋণগ্রহীতার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি ভাবা যেতে পারে। তবে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমান অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে আমার মনে হয় না। ঋণখেলাপিরা যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে সুবিধাভোগী দল বনে যায়, তাহলে সাধারণ ভালো ব্যবসায়ী, যারা ঋণের সঠিক ব্যবহার করে এবং নিয়মিত পরিশোধ করে, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঝামেলার শিকার হন। কারণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সাবধানতা বা শুদ্ধাচার তাদের ওপর চালানো হয়। অনেক সময় ভালো ব্যবসায়ী এমনকি ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
এখন এ খেলাপি ঋণের বোঝা কীভাবে মাথা থেকে নামানো যেতে পারে, তার পথ বের করা জরুরি। ঋণ দেয়ার আগে ভালো করে যাচাই করতে হবে, ঋণের টাকা সঠিক পথে ব্যবহার হয় কিনা, তা নিয়মিত নজরে রাখতে হবে, নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে ইত্যাদি পরামর্শ খুব কমন এবং এগুলো বর্তমানে খেলাপি ঋণের চেয়ে ভবিষ্যৎ খেলাপি হতে পারে এমন ঋণের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তাহলে বর্তমানে যেগুলো খেলাপি, সে ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে। অনেক কিছুই করা যেতে পারে, তবে তার বেশির ভাগই রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করে, কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে, কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হয়ে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নরম হয়ে রাষ্ট্র্র তথা সরকার এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বেছে নিতে পারে। এমন কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যার সব অথবা কিছু সংখ্যককে সঙ্কট উত্তরণের পথ হিসেবে যাচাই-বাছাই করা যেতে পারে।