২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুঁজিবাজার উন্নয়নে প্রয়োজন সমন্বয় কমিটি

-

তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা দেশের পুঁজিবাজারে সম্প্রতি একটি সুখকর সংবাদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ দিয়েছে। এ জন্য অর্থ ধার দিতেও রাজি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অপর দিকে আইসিবি ঘোষণা করেছে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা আইসিবির ইউনিট ফান্ডের ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম চালু করবে। এসব সিদ্ধান্তে বাজারে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। সেই সুবাদে সূচক ও শেয়ারদর পতনের বাজার ইতিবাচক ধারায় চলতে শুরু করেছে। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কয়েকটি উদ্যোগ।
জানা গেছে, সম্প্রতি পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু এরা সাফ জানিয়ে দেয় বিদ্যমান তারল্য পরিস্থিতিতে সম্ভব নয়। তারল্য সঙ্কট চলছে ১৫টি ব্যাংকের। অপর দিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও হাতগুটিয়ে বসে থাকে। এর প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। কমতে থাকে সূচক, পড়তে থাকে শেয়ারদর। আতঙ্কে লোকসান দিয়েও শেয়ার বিক্রিতে নামে বিনিয়োগকারীরা।
ফলে বিক্রয় চাপে কমতে থাকে বহুজাতিকসহ মৌলভিত্তি কোম্পানির শেয়ারদরও। এতে আরো দিশেহারা হয়ে উঠেন বিনিয়োগকারীরা। কারণ বাজারে এসব শেয়ারের দর সাধারণত নিচে নামে না। কিছুটা নামলেও দ্রুতই সংশোধন হয়ে যায়। কিন্তু এই পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। পতনকে আরো জোরালো করে টেলিকম খাতের জায়ান্ট কোম্পানি গ্রামীণফোন। প্রতিষ্ঠানটির সাথে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কর নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। কর ফাঁকির অভিযোগে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি পর্যন্ত দেয় সংস্থাটি। এতে শেয়ারদর কমতে থাকে প্রতিষ্ঠানটির।
এমন পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠক করেন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। এরপরই এরকম সিদ্ধান্ত জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। দেশের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বিএসইসি। বর্তমানে পুঁজিবাজারে ৫৬৯টি সিকিউরিটিজ তালিকাভুক্ত রয়েছে। এরমধ্যে ৩০০ এর অধিক হচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি।
এসব কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে আলাদা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে কোম্পানিগুলোকে কমপক্ষে দু’টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কোনো একটির সিদ্ধান্ত মানতে নিজের সরাসরি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিষয়টিও ভাবতে হয়। বর্তমানে কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, বিটিআরসি, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিএসইসি, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। আরো প্রয়োজন হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেশনগুলোর জন্য সরকার।
অর্থমন্ত্রী ও বিএসইসির উদ্যোগের ফলে বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা শুরু হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, তারল্য সরবরাহ হলে লোকসান কাটিয়ে উঠা যাবে।
কিন্তু এসব উদ্যোগের কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য প্রবাহের সুযোগ তৈরি করে দিলেও তা দিয়েছে শর্তযুক্তভাবে। এই শর্তের ফলে ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলে বিনিয়োগ করতে পারবে। এটি বাধ্যবাধকতার জায়গায় রাখা হয়নি। এটি সম্ভবও নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকগুলো এতদিন বলেছিল, তারল্য সঙ্কট। এখন তো সেই সঙ্কটের সমাধান দেয়া হয়েছে। তা হলে বিনিয়োগ হবে না কেনো। যার যার জায়গা থেকে সবাইকে পুঁজিবাজার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। নইলে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
অপর দিকে আইসিবি একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যাকে অর্থায়ন করলে পুঁজিবাজার সরাসরি লাভবান হয়। আইসিবির ইউনিট ফান্ড এতদিন ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ ছিল। ফলে কোনো ইউনিটধারী ব্যক্তি চাইলে আইসিবির কাছে তা সারেন্ডার করে টাকা তুলতে পারে। কিন্তু এই ইউনিট কারো কাছে বিক্রি করতে পারে না। এমনকি আইসিবিও না। অথচ বে-মেয়াদি এই ফান্ডটিতে বিনিয়োগ লাভজনক। আইসিবির এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের কারণে সম্ভব হয়েছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাজারের উন্নয়নে সরকারকেই আগ্রহী হতে হবে। এ জন্য কোম্পানি সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে একটি প্লাটফর্মের আওতায় আনা জরুরি। যেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বাজার উন্নয়নে যার যার অবস্থান থেকে নীতি সহায়তা ও দিকনির্দেশনা দেবে। নতুন নির্দেশনা দেয়ার বেলায় অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর কেমন প্রভাব পড়বে তা নিয়েও যেনো আগাম প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়।
এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রধান বা দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি করা যেতে পারে। এটির নাম যেকোনো কিছু হতে পারে। কমিটির কার্যপরিধি কী হবে তা নির্ণয় করে একটি সরকারি প্রজ্ঞাপণ জারি করা যেতে পারে।
অর্থমন্ত্রী ব্যস্ত দায়িত্বশীল হওয়ায়, তার পরিবর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রাখা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রীকে সর্বোচ্চ কোনো পদে রাখতে হবে। যাতে বিশেষ মুহূর্তে বা স্পর্শকাতর সময়ে তার কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এমনও হতে পারে নীতিমালা সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বা এখানে নীতিমালার বাইরে গিয়ে নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন। সে জন্য অর্থমন্ত্রীকে রাখতেই হবে।
এই কমিটি একটি প্লাটফর্মের মতো কাজ করবে। নিয়মিত বৈঠক, সভা ও পর্যালোচনা করবে। এতে বাজারের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা নেয়া সম্ভব হবে। বিনিয়োগকারীদের কাছে রাষ্ট্রীয় একটি বার্তা যাবে, পুঁজিবাজার উন্নয়নে সরকার আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। লাখো বিনিয়োগকারী নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করতে পারবে।
২০১০ সালে পুঁজিবাজারের পতনের পর থেকে বিনিয়োগকারীরা অল্পতেই আঁতকে উঠেন বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। এ জন্য এই বাজারে বিনিয়োগকারীদের বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনতে এমন একটি উদ্যোগ সময়ের দাবি। বাজার পতনের পরে সম্মিলিত উদ্যোগের ফলেই সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
এখন প্রয়োজন এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। এ জন্য একটি আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ প্রয়োজন। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এমন সমন্বিত উদ্যোগের ধারাবাহিকতা রক্ষায় রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement