বড় ভূমিকা রাখতে পারে দ্রুতগতির দৃশ্যমান তদন্ত রিপোর্ট
- এস কে তৈয়ব
- ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০
সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনীতির কয়েকটি সূচকের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। রফতানি বৃদ্ধি, আবাসিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং কমে যাওয়া, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি। অর্থনীতির আয়না বলে খ্যাত পুঁজিবাজার এই উন্নতির সাথে তাল মিলিয়ে সঙ্গী হচ্ছে না। এ জন্য একাধিক কারণকে দায়ী করা হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ার দরে কারসাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তদন্ত করে আসছে। কিন্তু এখনো সেই তদন্তগুলোর বেশির ভাগই আলোর মুখ দেখেনি। এগুলো দ্রুত কার্যকর ও আলোর মুখ দেখলে পুঁজিবাজারের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারের বস্ত্র খাতের একটি কোম্পানির কয়েক পরিচালক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা উপেক্ষা করে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নিজ নামে থাকা শেয়ার শেয়ার বিক্রি করে দেন। আরেকটি কোম্পানির শেয়ার নিয়ে এক বিনিয়োগকারী প্রচুর কেনা-বেচা করেন। এতে তাকে সহযোগিতা করে কয়েকজন বিনিয়োগকারী ও ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান।
দু’টি বিষয়েই গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হয়। এ দু’টি ঘটনাই বিএসইসির নজর এড়িয়ে যায়নি। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। উত্তর-পাল্টা উত্তরের মাধ্যমে শাস্তি নির্ধারণে পেরিয়ে যায় দুই বছরের বেশি সময়। শেষ পর্যন্ত এ দু’টি ঘটনায় কে কেমন শাস্তি পেল তা জানতে বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষা করতে হয় আরো বেশ কিছু সময়। এ সময়ের মধ্যে অনেকেই ঘটনা ভুলে যান, নয়তোবা বাজারে নতুন ঘটনার জন্ম দেয়ায় পুরনোটি ফিকে হয়ে যায়।
সম্প্রতি পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন নিয়েও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএসইসি। সেই আলোকে দেশের নামকরা ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শীর্ষ শেয়ার লেনদেনকারীদের তথ্য চাওয়া হয়। এ তালিকা প্রস্তুত ও জমা দিতেও বেশ সময় নেয় ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো। তালিকা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ ঘটনার কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ হয়নি। তদন্ত হওয়া মানেই বিনিয়োগকারীরা আশা করেন এর রিপোর্ট প্রকাশ হবে। কিন্তু যেভাবে দ্রুত প্রকাশ হওয়া দরকার, তা হচ্ছে না।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ১৩টি কোম্পানি বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা প্রতিদিন ঝুলিয়ে রাখছে। বলছে, এসব কোম্পানির বিষয়ে ডিএসই তদন্ত করবে। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন ও কোম্পানির প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করবে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজারে খবর করা হয়েছে, এসব কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হবে। উৎপাদনে না থাকা ও কোম্পানির ভবিষ্যৎ ভালো হওয়ার মতো কোনো কার্যক্রম না থাকলেও বাড়ছিল শেয়ার দর। বছরখানেক হলেও এখনো কোনো পরবর্তী পদক্ষেপ দেখতে পাননি বিনিয়োগকারীরা।
এতে বাজার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় ফাটল ধরছে। এর বাইরে অনেক বিষয়ের তদন্ত কমিটি গঠন ও তদন্ত শেষ করা হয়। এ বিষয়গুলো বিনিয়োগকারীরা জানেই না। একটি অপরাধ হওয়ার পরে যদি দুই থেকে তিন বছর পরে এর শাস্তি নিরূপিত হয়, তা হলে অন্য অপরাধীরা জানবেই কিভাবে শাস্তির কথা। গণমাধ্যমগুলোতেও সেই শাস্তি প্রকাশের বিষয়েটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কারণ তখন বিষয়টির গুরুত্ব অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে যায়। এর একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, বাজারে তখন এর চেয়েও বড় ঘটনার জন্ম হয়েছে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বিশ্বাস করেন, বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে সব শেয়ার লেনদেন প্রক্রিয়ায়। রিয়েলটাইম সার্ভারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের প্রতিটি বিষয়ের তথ্য পর্যালোচনা করতে পারছেন তাৎক্ষণিকভাবেই। কোনো শেয়ার কারসাজিকে ধরতে বা কোনো কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি শুরু হলে তৎক্ষণাৎ তা সম্ভব।
শুধু প্রয়োজন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া। এতে বাজারে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। বাজারকে বাজারের গতিতে চলতে শেখানো যাবে। আমাদের বাজারে এখনো অনেক কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। অবশ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, ঘন ঘন বাজারে হস্তক্ষেপ করলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে বিনিয়োগকারীরা ভড়কে যাবেন। আবার সব কিছুই করতে হয় একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আমাদের বিদ্যমান আইনিকাঠামো অনুসরণ করেই সব কিছু করতে হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ কথার সাথে একমত হচ্ছেন প্রায় সব ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, দোষীকে অবশ্যই যথাসময়ে শাস্তি দিতে হবে। শেয়ার কারসাজিরা অঘটন ঘটিয়ে চুপ মেরে বসে থাকেন। কোনো কোনো ঘটনায় তারা শাস্তি পান ঠিকই, কিন্তু যে পরিমাণ শাস্তি পান; তার চেয়ে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেন। আবার অনেকে সরল মনের স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে এটি আর হবে না।
আমি বেশি সতর্ক থাকব। আমি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন দেখেই বেশি শেয়ার কিনেছি। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ক্রয় বা বিক্রয় করিনি। তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বিনিয়োগকারীর প্রতি সদয় হয়ে, শাস্তির মাত্রা কমিয়ে দেন। কিছু ক্ষেত্রে শুধু সতর্ক করেই ছেড়ে দেন; যা পরবর্তীতে গণমাধ্যমে প্রচারও পায় না।
এ জন্য আগে যেভাবে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেনের মাধ্যম বিও অ্যাকাউন্ট বেড়েছিল, এখন তার চেয়ে তীব্র গতিতে কমে আসছে। বাজার ছাড়ছেন পুরনোরা। দেশের ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে ঢিমেতালে। প্রতিনিয়ত চলছে কর্মী ছাঁটাই। যাদের হাত ধরে বাজারের পথচলা শুরু হয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকার লড়াই করছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করা ও অপরাধীদের শাস্তির পরিমাণ অপরাধ অনুযায়ী করতে হবে। এতে বাজারের কারসাজির পরিমাণ কমবে। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এখন বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে নতুন নতুন বিনিয়োগকারীরা এ বাজারে ফিরে আসবে। পুরনোরা থাকবে এ বাজারেই। দেশের অর্থনীতির ক্ষত হিসেবে পরিচিত পাওয়া পুঁজিবাজারও উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে। নইলে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের উন্নয়নের সাফল্যর গাঁথা ম্লান হওয়ার জন্য এই পুঁজিবাজারই যথেষ্ট। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপ করা জরুরি। এটি না হলে এই বাজারের উন্নয়ন আশাতীত বলেই বিশ্বাস করবেন সংশ্লিষ্টরা।