০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

পুঁজিবাজারে চড়া সুদের ধাক্কা

-

ব্যাংকে আমানতের সুদহার ও ঋণের সুদহার বাড়া বা কমার প্রভাব অর্থনীতির সব ক্ষেত্রেই পড়ে। সাধারণত, আমানতের সুদহার বাড়লে আমানতকারীরা লাভবান হন। কিন্তু আমানতকারীদের বর্ধিত সুদ ব্যাংকগুলো বা ব্যাংকারেরা নিজেদের পকেট থেকে দেন না। তারা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বেশি সুদ আদায় করে আমানতকারীদের বর্ধিত সুদ পরিশোধ করেন। বিনিয়োগকারীরা বর্ধিত সুদে ঋণ নিয়ে যে শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ করেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। আর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে বাড়তি মূল্য ভোক্তাদের দিতে হয়। বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি। এভাবেই আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ও নগদ টাকার আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলোতে কমে গেছে বিনিয়োগ করার মতো তহবিল। টাকার সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে এক দিকে ব্যাংকগুলোর তহবিল সরবরাহ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সুদ। আর এর ধাক্কা অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মুতো পুঁজিবাজারেও পড়েছে।
সঞ্চয়ী আমানতে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ বেরিয়ে যাচ্ছে। মূলধন তুলতে অব্যাহত শেয়ার বিক্রিতে অস্থির হয়ে উঠেছে পুঁজিবাজার। আর বিনিয়োগ বেরিয়ে যাওয়ায় প্রতিদিনই কমছে বাজার মূলধন।
পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক অস্থিরতায় অন্য অনেক কারণের অন্যতম একটি হলো ব্যাংকের উচ্চ সুদহার। তারল্য সঙ্কট, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ ও ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের চাপে উচ্চ হারে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংক। সঞ্চয়কারীরাও উচ্চ হারে সুদ পাওয়ায় পুঁজিবাজার ছেড়ে ব্যাংকের সঞ্চয়ে ফিরছে। অনেকে কিনছে সঞ্চয়পত্র।
ব্যাংকে সঞ্চয়ের বিকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারে অনেক বিনিয়োগ আসে। বিশেষ করে ব্যাংকে সঞ্চয়ে সুদহার কম হলে পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। ব্যাংকের সঞ্চয় উঠিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের শেয়ার কেনে অনেক বিনিয়োগকারী। কারণ বছর শেষে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক কমপক্ষে ১০ শতাংশ আবার কোনো ব্যাংক ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি লভ্যাংশ দেয়। নগদ লভ্যাংশে বিনিয়োগকারী সরাসরি মুনাফা পায়। বোনাস লভ্যাংশ শেয়ার বরাদ্দ তো আছেই।
স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে (১০ মার্চ-১০ এপ্রিল) পুঁজিবাজার থেকে ২২ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই মূলধনের বড় অংশই ব্যাংকের সঞ্চয়ে বিনিয়োগ হয়েছে। আবার কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করে মূলধন জমা রেখে বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, তারল্য সঙ্কট কাটাতে চড়া সুদে আমানত সংগ্রহ করছে বাণিজ্যিক ব্যাংক। ৬ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ আর ৯ শতাংশে বিতরণের ঘোষণাকে পাত্তা না দিয়ে কেউ কেউ ৯ শতাংশের বেশিতে আমানত সংগ্রহ করছে। আর ঋণ বিতরণ করছে ১৫-১৮ শতাংশে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্চ মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৪১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে ১১টি গত মাসের চেয়ে আমানত সংগ্রহের হার বাড়িয়েছে। মেয়াদি আমানতে ৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১০.২৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদে আমানত সংগ্রহ করছে তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৩১টি ব্যাংক তাদের ঋণের গড় সুদহার বাড়িয়েছে। আগের মাসে ঋণের সুদহার বাড়িয়েছিল ২৮টি ব্যাংক। আর ডিসেম্বরে বাড়ায় ২৭টি ব্যাংক। সর্বশেষ মার্চ মাসেও ছয়টি ব্যাংক তাদের ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে।
এমনি পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে তারল্য বাড়াতে বিকল্প উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন, আমাদের পুঁজিবাজার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইক্যুইটি বা পুঁজির ওপর ভর করেই চলছে। কারসাজি, সিন্ডিকেটেশন, ইনসাইডার ট্রেডিং, যোগসাজশের মাধ্যমে শেয়ার দর বৃদ্ধি বা কমানোর প্রক্রিয়া এখনো বন্ধ করা যায়নি। গুজব নির্ভরতা কাটেনি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই আয়ের একমাত্র উৎস শেয়ার হাতবদলের মুনাফা। এজন্য প্রতিদিনই মুনাফা চায়।
বন্ড ছেড়ে কয়েকটি কোম্পানি অর্থ সংগ্রহ করলেও বিনিয়োগকারীরা এখনও এই বিষয়ে জ্ঞাত নন। সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি আলোচিত হলেও তা জোরালো হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসিনতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। মেগা প্রকল্পগুলো বন্ডের অর্থে নির্মিত হলে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমে যাবে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র খাতেও উচ্চ সুদ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না।
এতে ব্যাংকগুলোও আমানত সঙ্কটে ভুগবে না। বছর শেষে নিশ্চিত মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীও স্বল্পমেয়াদি মুনাফার দিকে ছুটবে না। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বন্ডকেই বেছে নেবে। এতে পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য কমবে।
বাংলাদেশে বন্ড মার্কেটের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিষয়টি এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ বন্ড মার্কেটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী এবং কর্তৃপক্ষ উভয়ই লাভবান হবে। জিরো কুপন বন্ড, ফিক্সড কুপন বন্ডের মতো পণ্য আনা যেতে পারে সহজেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বন্ড মার্কেট উন্নয়নের বিষয়টি স্বীকার করে আসছেন নিয়মিত।
বন্ড মার্কেট উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। সিআইবির নীতিমালাও সংশোধন করতে হবে। আর এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত। কারণ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাকিয়ে থাকেন সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে। আগে এটি কম হলেও এখন নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সরকার পরিচালনায় থাকা কর্তাব্যক্তিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বন্ড মার্কেট উন্নয়নের।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল