খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল
- আশরাফুল ইসলাম
- ০১ এপ্রিল ২০১৯, ০০:০০, আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯, ২৩:২২
কোনো ঋণের কিস্তি পরপর তিন মাস পরিশোধ না করলে ওই ঋণকে ব্যাংকিং ভাষায় সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা নি¤œমানের ঋণ বলা হয়। অনুরূপভাবে কোনো ঋণ পরপর ছয়মাস পরিশোধ না করলে ডাউটফুল বা সন্দেহজনক ঋণ, আর ওই ঋণ পরপর ৯ মাস অতিক্রান্ত হলে তা ব্যাড অ্যান্ড লস বা কুঋণ বলা হয়। এ তিন শ্রেণীর ঋণই খেলাপি হিসেবে বিবেচিত। কোনো গ্রাহক খেলাপি হওয়ার পর ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারেন না। এমন কি কোনো জাতীয় নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারেন না। গ্রাহককে সুবিধা দিতে তাই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। তবে কোনো গ্রাহককে বারবার এ সুযোগ দেয়ার বিধান নেই। সর্বোচ্চ তিনবার এ সুবিধা পেতে পারেন একজন গ্রাহক। তবে প্রথমবার তাকে মোট খেলাপি ঋণের ১৫ শতাংশ এককালীন নগদে পরিশোধ করে এ সুবিধা নিতে হয়। এরপরের দুইবার আরো বেশি এককালীন পরিশোধ করতে হয়।
তবে রাজনৈতিক চাপে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিতে এ পুনঃতফসিলকৃত ঋণের নাম ও ধরন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হতে দেখা যায়। কখনো ‘বিশেষ সুবিধা’ কখনো ‘পুনর্গঠন’ ইত্যাদি নামকরণ করা হয়। যেমন, ২০১৫ সালে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল না বলে ‘পুনর্গঠন’ নাম দেয়া হয়। ওই বছর মাত্র ১ ও ২ শতাংশ এককালীন পরিশোধ করে ১৪টি শিল্পগ্রুপকে ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করার সুযোগ দেয়া হয়। আবারো রাঘব বোয়াল ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য নীতিমালা তৈরি করার কাজ শুরু করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারো হয়তো বড় অংকের খেলাপি ঋণ বিশেষ সুবিধার নামে নবায়ন করা হবে নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে। খেলাপি ঋণ, পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত এ ঋণকে স্টেসড’ বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৮ সালে রেকর্ড ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেছে ব্যাংকগুলো। একই বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। এর সাথে বিদায়ী বছরে পুনঃতফসিলকৃত ঋণ যোগ করলে ২০১৮ সাল শেষেও দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ২২ শতাংশের বেশি দাঁড়ায়। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের হার ছিল ১৯ শতাংশ।
ব্যালান্সশিট পরিচ্ছন্ন দেখাতে ব্যাংকগুলো বাছবিচার ছাড়াই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করছে। আইন অনুযায়ী কোনো ঋণ তিনবারের বেশি পুনঃতফসিলের সুযোগ না থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। প্রভাবশালী গ্রাহকরা ১০ বারেরও বেশি পুনঃতফসিল সুবিধাও নিয়েছেন। তার পরও সে ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের চেয়ে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠিত ঋণের হার বেড়ে গেছে।
স্ট্রেসড ঋণের হার খেলাপি ঋণের দ্বিগুণ হওয়ায় ব্যাংকিং খাতে যেমন ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, তেমনি ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিসংখ্যান কিংবা ব্যাংকগুলোর ব্যালান্সশিটে দেখানো চিত্রই দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা নয় বলে মনে করেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো নিজেদের অবস্থা ভালো দেখাতে অনেক তথ্যই গোপন করছে। অনেক ঋণ বহু আগেই খেলাপি হওয়ার উপযুক্ত হলেও তা খেলাপি দেখানো হচ্ছে না। শাখা ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে শীর্ষ নির্বাহী সবাই নিজেদের দক্ষ ও সফল দেখানোর চেষ্টা করছেন। বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাথে যুক্তদের ঋণ খেলাপি হলেও কৌশলে তা গোপন রাখা হচ্ছে। নিজেদের সফল দেখাতে অনেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আয় নয়, এমন অর্থও আয়ের খাতে দেখাচ্ছেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় পরিচালিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষায়ও এমন চিত্র উঠে এসেছে। সাধারণত ১৫ মার্চের মধ্যেই আগের বছরের আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে ব্যাংকগুলো। কিন্তু এবার মার্চ শেষ হতে চললেও বেশির ভাগ ব্যাংকই আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। অনেক ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের হিসাবে বড় ত্রুটি ধরা পড়ছে। খেলাপি হওয়ার উপযুক্ত হলেও খেলাপি দেখানো হয়নি এমন ঋণও উদ্ঘাটিত হচ্ছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাযথ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়নি, ইতঃপূর্বে বাড়তি মুনাফা দেখানোসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা দলের কাছে ধরা পড়েছে।
দীর্ঘ দিন ব্যাংকাররা বলে আসছেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না কিছু ব্যবসায়ী। দীর্ঘ দিন ঋণ পরিশোধ না করায় এ ঋণ এখন আদায় অযোগ্য বা কুঋণে পরিণত হয়েছে। এদের কেউ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ঋণ নবায়ন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কিস্তি পরিশোধ না করায় আবার ওই ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার তালিকায় থাকা শীর্ষ ২৫ ঋণখেলাপির পকেটে রয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। যদিও এ তালিকায় অনেক রাঘব বোয়াল ঋণ গ্রহীতার নাম নেই।
দীর্ঘ দিন আদায় না হওয়ায় এ ঋণ এখন ব্যাংকের খাতায় গলার কাঁটা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ এসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। পাশাপাশি এসব ঋণের বিপরীতে অর্জিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তরিত করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকের বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মামলা করেও দীর্ঘ দিন তা ঝুঁলে রয়েছে।
খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য কয়েক বছর ধরে বিপদ সঙ্কেত বাজিয়ে যাওয়া বিষয়। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন খাতের উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের বিপরীতে ব্যাংক খাতে উল্লেখযোগ্য অবনতির দাগ প্রকাশ করছে এ খেলাপি ঋণ। সরকারের অন্যান্য সাফল্যকে সবচেয়ে বেশি ঢেকে দিচ্ছে ব্যাংকিং খাতের এ কালো দাগ। খেলাপি ঋণের এ প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যদি শক্ত হাতে একে মোকাবেলা করা না হয়, তাহলে অদূরভবিষ্যতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধসের কারণ হতে পারে ব্যাংকিং খাতের এ কালো ছায়া।
খেলাপি ঋণের কারণে গোটা অর্থনীতি আসলে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়লেও ঋণগ্রহীতার যে কোনো বিপদ নেই, তা ভাবার কারণ নেই। আখেরে ঋণগ্রহীতার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি ভাবা যেতে পারে। তবে তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বর্তমান অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে বলে আমার মনে হয় না। ঋণখেলাপিরা যদি আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে সুবিধাভোগী দল বনে যায়, তাহলে সাধারণ ভালো ব্যবসায়ী, যারা ঋণের সঠিক ব্যবহার করেন এবং নিয়মিত পরিশোধ করেন, তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ঝামেলার শিকার হন। কারণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সাবধানতা বা শুদ্ধাচার তাদের ওপর চালানো হয়। অনেক সময় ভালো ব্যবসায়ী এমনকি ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
এখন এ খেলাপি ঋণের বোঝা কিভাবে মাথা থেকে নামানো যেতে পারে, তার পথ বের করা জরুরি। ঋণ দেয়ার আগে ভালো করে যাচাই করতে হবে, ঋণের টাকা সঠিক পথে ব্যবহার হয় কি না, তা নিয়মিত নজরে রাখতে হবে, নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে ইত্যাদি পরামর্শ খুব কমন এবং এগুলো বর্তমানে খেলাপি ঋণের চেয়ে ভবিষ্যৎ খেলাপি হতে পারে এমন ঋণের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তা হলে বর্তমানে যেগুলো খেলাপি, সে ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে। অনেক কিছুই করা যেতে পারে, তবে তার বেশির ভাগই রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করে, কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে, কিছু ক্ষেত্রে কঠোর হয়ে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নরম হয়ে রাষ্ট্র তথা সরকার এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ বেছে নিতে পারে। অন্যথায় ব্যাংকিং খাতের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না। আর এটা হলে গোটা অর্থনীতির ওপরই এর প্রভাব পড়বে।