০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

পুঁজিবাজার : সুযোগ নিচ্ছে দুষ্টচক্র

-

আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধে ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা কমিয়ে এনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সময় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাপে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৭ মার্চ ব্যবসায়ীদের চাপে তৃতীয়বারের মতো সার্কুলার পরিবর্তন করল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলেও বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, একই সিদ্ধান্ত নিয়ে তৃতীয় দফা সংশোধনীর মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো সার্কুলার জারি করল বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপানোর আগে এর প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে যেমন নানা প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে, তেমনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সুযোগ নিচ্ছে একটি দুষ্টচক্র। তারা এটার সুযোগ নিয়ে বাজারে নানা কারসাজির মাধ্যমে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি। সাধারণের প্রশ্ন, বিনিয়োগসীমা কেনই বা কমানো হয়েছিল, আবার কেনই বা কার্যকারিতার সময়সীমা বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর চেয়ে বিনিয়োগসীমা আগের অবস্থানেই রাখা ভালো ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের শেষ দিকে যখন এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন ব্যাংকিং খাতে ঋণ প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিল। তখন বাস্তবে বিনিয়োগ চোখে না পড়লেও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। আগ্রাসী এ ব্যাংকিংয়ের কারণে ঋণ আমানতের অনুপাত কোনো কোনো ব্যাংকের শতভাগ ছেড়ে যায়। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে ৮৫ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর এমন আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। দীর্ঘ দিন ধরে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১০ শতাংশের নিচে। সাধারণত, ঋণের প্রবৃদ্ধি আমানতের চেয়ে কম হওয়ার কথা, সেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
তহবিল ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়ার আগেই ওইসময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি ব্যাংকগুলোর জন্য এ বিষয়ে এক সার্কুলার জারি করা হয়। বলা হয়, ঋণ আমানতের অনুপাত প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে ৮৫ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৮৩ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ৮৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এর জন্য সময় দেয়া হয় প্রথম ছয় মাস। অর্থাৎ যেসব ব্যাংকের অতিরিক্ত বিনিয়োগ থাকবে তাদের গত বছরের ৩০ জুনের মধ্যে পুনর্নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে বলা হয়। কিন্তু ব্যাংকের ব্যবসায়ী পরিচালকদের চাপের মুখে গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সার্কুলার দিয়ে সময়সীমা ছয় মাস বাড়ানো হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালনের সময়সীমা ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করা হয়। কিন্তু এতেও ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট না হয়ে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। ব্যাংকের ব্যবসায়ী পরিচালকরা হোটেল সোনারগাঁওয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে নিয়ে এক বৈঠকের আয়োজন করে। ওই বৈঠকের পর গত বছরের ৯ এপ্রিল আবারো সার্কুলার সংশোধন করে বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ের সময় আরো তিন মাস বাড়িয়ে ৩১ মার্চ করা হয়। যা চলতি মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আলোচ্য সময়েও তা সমন্বয় করতে না পারায় বিনিয়োগসীমা নিয়ে তৃতীয় দফা সংশোধনের মাধ্যমে চতুর্থ দফা সংশোধন করল বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের মহাব্যবস্থাপক মো: রেজাউল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে বিনিয়োগসীমা সমন্বয়ে আরো ছয় মাস বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে।
এ দিকে, ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সিদ্ধান্তে থাকতে না পারায় একটি দুষ্টচক্র শেয়ারবাজার থেকে অনৈতিক সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হবে, কিছুতেই তা থেকে সরে আসা যাবে না। এতে সাময়িক কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ একটি সময় পর তা ঠিক হয়ে যাবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভালো সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তা সবার কাছেই ভুল বার্তা দেবে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের শুরুতেই শেয়ারবাজারে তেজিভাব দেখা দেয়। কিন্তু এডিআর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এসে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়। শেয়ারবাজারের এই নেতিবাচক প্রভাব গত সপ্তাহেও ছিল। কিন্তু গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় ছয় মাস বাড়িয়ে দিলে রোববার শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পর থেকেই আবার দরপতন হতে থাকে।
এডিআর সমন্বয়ের সীমা বারবার বাড়ানোর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। সাড়ে ৮৩ শতাংশ করার বিষয়ে বারবার সময় বাড়ানো হচ্ছে। এটার একটা কারণ হয় তো বলবে তারল্য সঙ্কট। কিন্তু সার্বিকভাবে ব্যাংকিং সিস্টেমে কোনো তারল্য সঙ্কট নেই। কিছু কিছু ব্যাংকের আছে। কাজেই এটা (সময় বাড়ানো) কারার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল বলে আমার মনে হয় না। এ সবকিছুই করা হচ্ছে চাপের মুখে। এর আগে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এবং রেপো রেট কমানো হয়েছে। কিন্তু তাতে তো বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়নি। তার মানে সমস্যা সরবরাহের ক্ষেত্রে না, চাহিদার ক্ষেত্রে। যেহেতু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা আছে, সে কারণে লোকে ঋণ নিতে চাচ্ছে না, বিনিয়োগ হচ্ছে না। যে কারণে মূলধনী পণ্যের আমদানি কমে গেছে।
এ দিকে, এডিআর সমন্বয়ের সময় শেষ হয়ে এলেই শেয়ারবাজারে একধরনের অস্থিরতা দেখা দেয়, এর কোনো অর্থ নেই। এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ৮৩ শতাংশ করলে শেয়ারবাজারে তারল্য খুব একটা কমতি হবে না। শেয়ারবাজারের বড় সমস্যা সঞ্চয়পত্রের সুদ হার বেশি থাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ। একদিকে ঝুঁকি নেই, অন্যদিকে সুদ হার বেশি হওয়ায় সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল