০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

ব্রেক্সিট অচলাবস্থায় লাভবান চীন

-

ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর ৩৩ মাস কেটে গেলেও ইইউ থেকে কী উপায়ে প্রস্থান হবে, তা নিয়ে ব্রিটেনের আইনপ্রণেতারা ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি। ইউরোপে যখন ব্রেক্সিট নিয়ে বিশৃঙ্খলা চলছে, তখন এ পরিস্থিতিতে চীনেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সামনে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বাহ্যিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ আগামী মাসে চীনের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় একটি সম্মেলন। এ সম্মেলনের সম্ভাব্য আলোচ্যসূচি নির্ধারণে গত সপ্তাহে ইইউ নেতারা একটি বৈঠকে বসলেও শেষ পর্যন্ত ব্রেক্সিট নিয়েই আলোচনা শেষ করেছেন তারা।
২০১৬ সালের ব্রেক্সিট গণভোটের রায় অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ রাত ১১টায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ ত্যাগের কথা ছিল ব্রিটেনের। ব্রেক্সিট পরবর্তীকালে ইইউয়ের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্কের শর্ত নির্দিষ্ট করে তৈরি হয় ব্রেক্সিট চুক্তি। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে দুই দফায় তা হাউজ অব কমন্সে পাস করাতে ব্যর্থ হন। তৃতীয় দফায় চুক্তিটি পার্লামেন্টে তোলার আগে ইইউ নেতাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের তারিখ পরিবর্তন করাতে সমর্থ হন থেরেসা মে। শুক্রবার তৃতীয় দফায় ভোটাভুটির আগে তিনি বলেছিলেন, তার প্রস্তাবিত ব্রেক্সিট চুক্তিতে যদি এমপিরা সমর্থন দেন তাহলে তার বিনিময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতেও প্রস্তুত। তা সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যাত হয় তার ব্রেক্সিট পরিকল্পনা।
ব্রেক্সিট চুক্তি তৃতীয় দফায় হাউজ অব কমন্সে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও ভেঙে পড়ছেন না ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। তিনি ও তার মন্ত্রিপরিষদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদের এই চুক্তি চতুর্থ দফায় পার্লামেন্টে ভোটে তোলার পরিকল্পনা করছেন। তাদের প্রত্যাশা এমপিরা চতুর্থ দফায় এতে সমর্থন দেবেন। শুক্রবার ৫৮ ভোটের ব্যবধানে তৃতীয়বারের মতো পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর থেরেসা মে বলেছিলেন, ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্যের একটি বিকল্প পথে এগোনোর দরকার হতে পারে। এরই মধ্যে বিকল্প আটটি প্রস্তাবের ওপর ভোট হয়ে গেছে। তাতে কোনো প্রস্তাবই পাস হয়নি। ফলে আজ সোমবার চতুর্থ দফায় আরেকটি ‘ইন্ডিকেটিভ ভোট’ হওয়ার কথা রয়েছে। তাতে সব দলের এমপিরা ভোট দেবেন।
এদিকে ইউরোপীয় নেতাদের সাথে বৈঠক করতে আগামী মাসে ব্রাসেলস যাচ্ছেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। এ সফর শেষে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের ১৬টি দেশের একটি জোটের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করতে ক্রোয়েশিয়া যাবেন তিনি। অনেকের আশঙ্কা, বৃহত্তর ইইউকে বিভক্ত করার জন্য এ ধরনের জোটকে ব্যবহার করা হতে পারে।
গত সপ্তাহের বৈঠকের আগে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি) জানিয়েছিল, চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একাধারে সহযোগী অংশীদার, যার সাথে ইইউর লক্ষ্যের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে; মধ্যস্থতাকারী অংশীদার, যার সঙ্গে ইইউর স্বার্থের ভারসাম্য বহাল রাখা প্রয়োজন এবং প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের দিক থেকে অর্থনৈতিক প্রতিযোগী ও শাসনব্যবস্থায় বিকল্প মডেলের প্রতিদ্বন্দ্বী।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পর দেশটির দ্বিতীয় বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ইইউ। চীন ও ইইউর মধ্যে গড়ে দৈনিক ১০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। ফলে বেইজিংয়ের সাথে কিভাবে সমন্বয় করা যায়, সে বিষয়ে একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করা ব্রাসেলসের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ চীনের সাথে যে কোনো জটিলতাই ইইউ’র পক্ষে সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে উঠবে।
কিন্তু কিভাবে এ ভারসাম্য বহাল রাখা যায়, সে বিষয়ে জোটের মধ্যেই যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। জার্মানিসহ বেশ কিছু জোট সদস্যের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের দিক থেকে বেইজিংয়ের প্রতি কঠোর মনোভাব ক্রমে বাড়ছে। অন্য দিকে, বাকি দেশগুলোর চীনা বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহ বহাল রয়েছে।
ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পর চলতি মাসেই চীনা বিনিয়োগের প্রতি রোমের স্পষ্ট আগ্রহ দেখা গেছে। চলতি মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ইতালি সফরে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান ইতালির নেতারা। একই সাথে জি৭-ভুক্ত প্রথম দেশ হিসেবে জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড বাণিজ্য ও অবকাঠামো উদ্যোগে স্বাক্ষর করেছে ইতালি।
চীনের সাথে ইতালির ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে বার্লিনভিত্তিক মারকেটর ইন্সটিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের (এমইআরআইসিএস) গবেষণা সহযোগী লুক্রেজিয়া পোজেত্তি বলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের প্রকল্পে ইতালির অংশগ্রহণ বেইজিংয়ের জন্য কেবল অর্থনৈতিক বিজয়ই নয়, একই সঙ্গে ভবিষ্যতে বৃহত্তর ইইউ’র বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য একটি সম্ভাব্য হাতিয়ারও বটে।
তিনি আরো বলেন, একটি জোট হিসেবে নয় বরং ইইউ’র প্রতিটি দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে চুক্তি করতে বেশি আগ্রহী চীন। একক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকছে। এ ক্ষেত্রে পোজেত্তি মহাদেশটিতে চীনের অন্যতম দুই মিত্র গ্রিস ও হাঙ্গেরির আচরণগুলো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি দেখান, কীভাবে দেশ দুটি বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আচরণ নিয়ে ওঠা সমালোচনা থামিয়ে দেয় এবং ২০১৭ সালে এথেন্স কিভাবে চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইইউ’র একটি সমালোচনামূলক বিবৃতি আটকে দেয়।
দুটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, গ্রিসের মধ্যে চীন সরকারকে বিরক্ত করার এবং বেইজিংয়ের প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সুযোগ হারানোর ভয় কাজ করেছে। ফলে চীন নয়, বরং জোটের প্রতিশ্রুতির বিপক্ষে কাজ করেছে গ্রিস। অন্য দিকে হাঙ্গেরিও রাজনৈতিক দিক থেকে চীনের ঘনিষ্ঠ।
ঐতিহাসিকভাবেই ইউরোপের কিছু দেশের সঙ্গে বেইজিংয়ের শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। আবার যেসব ইউরোপীয় দেশ একসময় চীন অবরোধ করে দেশটিকে উপনিবেশ বানিয়েছে, সেসব দেশের সাথে ততটাই দুর্বল সম্পর্ক রয়েছে বেইজিংয়ের। চীনের সাথে ইইউর সদস্যগুলোর সাম্প্রতিক ও ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাকে জোটে বেড়ে চলা অন্তঃকলহের সাথে সংশ্লিষ্ট হিসেবে দেখাও হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএন


আরো সংবাদ



premium cement

সকল