০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

দুর্বল হয়ে পড়ছে টাকা

-

মার্কিন ডলারের বিপরীতে কমে যাচ্ছে টাকার মান। স্বাধীনতার ৪৭ বছরে এই ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ১০ হাজার শতাংশ বা ১০ গুণ। ১৯৭২ সালে প্রতি ডলার পেতে যেখানে ব্যয় হতো ৭ টাকা ৮০ পয়সা, বছরের পর বছর দাম বেড়ে সেই ডলার পেতে ২০১৮ সালের মে শেষে ব্যয় হচ্ছে ৮৪ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বিপরীতে টাকা দুর্বল হয়ে পড়ার নানা কারণ রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, যে হারে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি হচ্ছে, ওই পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে না। অর্থাৎ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় বেড়েছে, সেই হারে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বা রফতানি আয় বাড়েনি। ফলে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়েছে টাকার মান। বিপরীতে শক্তিশালী হয়েছে মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৭২ সালে প্রতি ডলারের জন্য ব্যয় হতো ৭ টাকা ৮০ পয়সা। ১০ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে হয় ১৮ টাকা ৩১ পয়সা। এর পরের ১০ বছরে, অর্থাৎ ১৯৯১ সালে তা আবারো দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৩৬ টাকা ৭৫ পয়সা। এর পাঁচ বছরের মাথায় তা ৪ টাকা বেড়ে হয় ৪০ টাকা ৮০ পয়সা। এর পরের পাঁচ বছরে, অর্থাৎ ২০০০ সালে তা আরো ১০ টাকা বেড়ে হয় ৫০ টাকা ৮২ পয়সা। ২০০১ সালে ছিল ৫৩ টাকা ৮৪ পয়সা। ২০০৫ সাল শেষে তা আরো বেড়ে হয় ৫৮ টাকা ১১ পয়সা। ২০০৯ সালে তা প্রায় ১০ টাকা বেড়ে হয় ৬৭ টাকা ৪০ পয়সা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৮০ টাকা ২০ পয়সা। গত ২৭ মার্চ শেষে তা ৮৪ টাকা ২৫ পয়সায় উঠে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সামনে এ সঙ্কট আরো বাড়তে পারে। কারণ, রেমিট্যান্স প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে, কিন্তু ব্যয় সেই তুলনায় কমছে না। ফলে সামনে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এটা হলে আমদানি ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে পণ্যের মূল্যের ওপর। এতে সাধারণের জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রফতানি আয় বা রেমিট্যান্স বাবদ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পায়, তা তাদের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে (বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলোর অ্যাকাউন্ট) আগে জমা হয়। পরে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে জমা ডলারের হিসাব তাদের প্রধান কার্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রতিটি ব্যাংকের তাদের দিনের লেনদেন শুরুর আগে কী পরিমাণ ডলার রয়েছে (নিট ওপেন পজিশন) তা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানাতে হয়। এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিটি ব্যাংকেরই বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার একটি কোঠা দেয়া থাকে। ওই কোঠার বেশি ডলার তাদের হাতে থাকলে তা অন্য কোনো ব্যাংক বা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে হবে। ব্যাংক বা গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে ব্যর্থ হলে তা ওইদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ওইদিনের দরেই ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হবে। অন্যথায় ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হয়।
কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত ডলার ছিল। বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে তা কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারদরে ডলার কিনে নিয়েছে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপ না করলে প্রতি ডলার পেতে ৬০ টাকার বেশি ব্যয় করতে হতো না। অর্থাৎ শক্তিশালী হতো টাকার মান। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে টাকা শক্তিশালী হয়নি।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় বাজারে উদ্বৃত্ত ডলার ছিল। ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করত।
এ দিকে কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। হুন্ডি প্রবণতাই অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন ব্যাংকাররা। এর ফলে প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়েও উন্নতি করতে পারছে না। রেমিট্যান্স আনার নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। হুন্ডি প্রতিরোধে মধ্যপ্রাচ্যে তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের টিম পাঠিয়েছে। এর পরও হন্ডি প্রতিরোধ হচ্ছে না। এ দিকে রফতানি আয়ও কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। সব মিলে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গেছে।
সাধারণত কম দামে পণ্য কিনে কম মূল্যে বিক্রি করা যায়। আর উচ্চমূল্যে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা হয়। টাকার মান কমে যাওয়ায় আগে যেখানে ১০০ টাকা দিয়ে যে পণ্য কেনা যেত, মান কমে যাওয়ায় একই পণ্য কিনতে হবে ১২০ টাকা। সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে শিল্পের ওপর। নানা কারণে নতুন শিল্পকারখানা বাড়ছে না। কমে যাচ্ছে শ্রমঘন শিল্প। ব্যবসায়ীরা নানা কারণে ব্যবসায়ে মার খাচ্ছেন। এর ওপর টাকার মান পড়ে গেলে আমদানিকৃত শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে যাবে। আর কাঁচামালের দাম বেড়ে গেলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ডলারের মান বেড়ে গেলে রফতানি ও রেমিট্যান্সের জন্য ইতিবাচক হলেও সামগ্রিকভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। কারণ, বাংলাদেশ অনেক কিছুতেই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ডলারের মান বেড়ে গেলে শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। আর পণ্যের আমদানি ব্যয় বাড়লে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে পণ্যের মূল্য। এতে দুই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হবে দেশ। এক দিকে, পণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। নির্দিষ্ট আয় দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারবে না। এতে দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে। যেমনÑ ১০০ টাকা দিয়ে একজন গ্রাহক যে পরিমাণ পণ্য কিনতে পারত, এখন ওই পণ্য কিনতে তাকে ১২০ টাকা ব্যয় করতে হবে। কিন্তু নির্ধারিত আয়ের মানুষের আয় বাড়ছে না। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য না কিনে কম পণ্য ভোগ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশীয় পণ্যের মূল্য বাড়লে বিদেশী পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে যাবে। এতে লোকসানের মুখে পড়বে অনেক শিল্পকারখানা। একজন শিল্পোদ্যোক্তা জানিয়েছেন, নানা কারণে তারা ব্যবসায়ে মার খাচ্ছেন। প্রতিবেশী ভারতে ব্যবসায়ীদের নানা ধরনের সহযোগিতা দেয়া হয়। তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার জন্য বিদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। ফলে তাদের পণ্য সহজেই তাদের বাজারে চলে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি হয় না, বরং দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিনিয়তই সরকার ভাট ও ট্যাক্স বাড়াচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে শিল্প স্থাপন করা যায় না। যেমনÑ বিদ্যমান ভ্যাট ও ট্যাক্স হিসাব করে এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করে শিল্পকারখানা স্থাপন করা হলো। এক বছর যেতে না যেতেই গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। বাড়ানো হলো ভ্যাট ও ট্যাক্সের হার। ফলে শিল্পের চাকা ঘুরলেও ব্যয়ের পরিকল্পনা ঠিক রাখা যায়। শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। এ সুযোগে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তায় পণ্য আসে। এভাবেই মার খায় স্থানীয় শিল্পকারখানা। ব্যাংকের ঋণনির্ভর উদ্যোক্তারা ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ঋণখেলাপি হয়ে যায়। এক সময় চালু শিল্পকারখানা রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে তা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই চালু কারখানা বন্ধ হয়ে বেকার হয়ে যান কর্মক্ষম শ্রমিক। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, টাকার মান কমে গেলে শিল্পকারখানার জন্য মহাদুর্যোগ নেমে আসবে। কেননা লোকসানের ঘানি টানতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। এতে চালু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন। বাড়বে ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হার। দেশেও আমদানি-নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যাবে।


আরো সংবাদ



premium cement