খেলাপি ঋণ বেড়ে হলো সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় এস আলম, এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, সালমান এফ রহমান এবং বড় কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ দেশের ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট করেছিলেন। লুট করা অর্থের একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। কিন্তু এসব ঋণখেলাপি হিসাবে না দেখিয়ে আড়াল করা হতো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোনের মুখে ৫ আগস্টের পর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এর পর থেকে খেলাপি ঋণ জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর শেষেই এ খেলাপি ঋণ সাড়ে তিন লাখে পৌঁছেছে। এর গন্তব্য ৬ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানোর আভাস পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আমি আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। তবে এখনো খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংকিং খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা ফেরানো। আমরা সেই কাজটিই করছি।

গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন। তিনি বলেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে দেয়া হবে। এ জন্য আইন তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে। কোনো আমানতকারী তাদের আমানত খোয়া যাবে না বলে আশ্বস্ত করেন। ব্যাংকে টাকা রেখে খোয়া যাবে তা হতে দেয়া যাবে না। এ জন্য সরকার কিছুটা দায়িত্ব নিয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হলো দেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর গ্রাহকের আস্থা ফেরানো। আমরা এ জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। তবে, কাক্সিক্ষত হারে আমানত আসছে না। ডিসেম্বর শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে হলে ভালো হতো। তিনি বলেন, আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা প্রায় ৪ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না।

খেলাপি ঋণের চিত্র বিশ্লেষণ করে গভর্নর বলেন, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে।
গভর্নর বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বেড়েছে। আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ বাড়বে। তবে এখনো খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি।’ তিনি আশ্বস্ত করেন, ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে মোট ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এই হার আগের প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে কিছুটা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে এই হার ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সূত্রগুলো বলছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ব্যাংকগুলো ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এস আলমসহ আরো কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এতেও বেড়েছে খেলাপি ঋণ।