বিএলআরআইয়ে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত কোয়েল পাখির মৃত্যুর তথ্য গোপন করেছেন ডিজি
- কাওসার আজম
- ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) শেডে গবেষণার জন্য ব্যবহৃত অ্যাডাল্ট (পূর্ণ বয়স্ক) কোয়েল পাখি মারা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, শতাধিক কোয়েল পাখি মারা গেছে। অনেকে বলছেন, এ সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। তবে বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক (সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত) ড. শাকিলা ফারুক দাবি করেছেন এ সংখ্যা ৮০-৮৫টি। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্র বলছে, বার্ড ফ্লু বা এভিয়েন ইনফ্লুয়েন্সার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এসব পাখি মারা গেছে। প্রায় ১০০টি মারা যাওয়ার পর শেড থেকে সব কোয়েল সরানো হয়। তার মধ্যে কিছু পুঁতে ফেলা হয়। আর ভালোগুলো সেল সেন্টারে বিক্রি করে দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ঘটনার প্রায় তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হতে চললেও বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রেখেছেন বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক (সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত) ড. শাকিলা ফারুক। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে মারা যাওয়া কোয়েল পাখিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কোয়েল শেডের পেছনে (উত্তর পাশে) সেপটিক ট্যাংকের ভেতরে রেখে চাপা দেয়া হয়। একই সাথে এই তথ্যটিও মাটিচাপা দিতে বিএলআরআইতে কঠোর নজরদারি বাড়ান তিনি। তবে বিষয়টি আর চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। মহাপরিচালক ঠিক কী কারণে বিষয়টি গোপন রাখলেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বার্ড ফ্লু ভাইরাসের ভয়াবহতা দেখেছে বাংলাদেশ। ভাইরাসটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, আমাদের পোলট্রি বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত গবেষণার ফল ছিল ৪-৫টি জাত। প্রাপ্ত বয়স্ক প্রায় দেড় হাজার কোয়েল পাখির ডিম থেকে বাচ্চা হয়। অ্যাডাল্ট ও বাচ্চাগুলো আলাদা শেডে রাখা হয়। কিন্তু ভাইরাস অ্যাটাক করে অ্যাডাল্ট শেডে। যার বেশির ভাগই মারা যায়। সময় মতো ভ্যাকক্সিন না দেয়ার কারণে এমন ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
আরেক কর্মকর্তা বলেন, এভিয়েন ইনফুয়েন্সার ভাইরাসটি ছোঁয়াচে এবং খুব দ্রুত ছড়ায়। কোয়েল থেকে ভাইরাসটি পোলট্রিসহ অন্যান্য প্রাণী আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঠিকমতো ভ্যাকসিনেশন বা বায়োসিকিউরিটি মেইনটেইন না করার ফলে বার্ড ফ্লুর মতো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। গবেষণার কোয়েল পাখি মারা যাওয়ার বিষয়টি গোপন করায় পুরো গবেষণার প্রাণিকুলকেই ডিজি হুমকির মুখে ফেলেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিভাগীয় প্রধান ও প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে শাকিলা ফারুকের উদাসীনতাকেই দায়ী করছেন অনেকে।
জানা যায়, বিএলআরআইতে অন্যান্য প্রাণির মতো কোয়েল পাখি নিয়েও গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের আওতায় এটি হয়ে আসছে। ড. শাকিলা ফারুক এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পিএসও)। চতুর্থ গ্রেডের এই কর্মকর্তা গত ১০ নভেম্বর বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালকের (সাময়িক) দায়িত্ব পান।
বিশ^স্ত সূত্রের খবর, গত মধ্য জানুয়ারির কোনো একদিন গবেষণার কাজে ব্যবহৃত একটি শেডে রাখা অ্যাডাল্ট সব কোয়েল পাখি মারা যায়। ঠিক কতটি পাখি মারা যায় তা নিয়ে নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি। তবে গত ডিসেম্বরে বিএলআরআইতে উপস্থাপিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, এ সংখ্যা প্রায় ১৪ শ’ থেকে ১৫ শ’র মতো। চার জাতের অ্যাডাল্ট কোয়েল পাখির মধ্যে রয়েছে ব্ল্যাক ৩৫৩টি, ব্রাউন ৩৬৮টি, ঢাকাই ৪০১টি এবং সাদা ৩৫৪টি। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অ্যাডাল্ট কোয়েল পাখির শেডের প্রায় সবই মারা গেছে। মহাপরিচালকের নির্দেশে অতিগোপনে মৃত এসব পাখি মাটির নিচে চাপা দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, এটি যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়। ভয়ে কেউই মুখ খুলছেন না। বিষয়টি নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি কথা হয় সাময়িক মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা ড. শাকিলা ফারুকের সাথে। তিনি জানান, তাকে সংশ্লিষ্ট সায়েন্টিস্ট (তারেকুল ইসলাম) জানিয়েছেন ৭০-৮০টা কোয়েল পাখি মারা গেছে।
সব মিলিয়ে কত কোয়েল পাখি ছিল. জানতে চাইলে তিনি জানান, টোটাল কোয়েল পাখি ছিল প্রায় দেড় হাজারের মতো। এগুলো ছোট বড় সব মিলিয়ে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওখানে সায়েন্টিস্ট তারেক কাজ করে তো, জেনে জানাচ্ছি। এ দিনই ফের তাকে ফোন দেয়া হলে তিনি জানান, তারেক বিএলআরআইয়ের বাইরে থাকে তো, সে আসতেছে। আসার পর বিস্তারিত জেনে আপনাকে জানাবে। তবে এরপর আর তিনি ফোন ধরেননি। সর্বশেষ গতকাল বিকেলে কয়েকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি ড. শাকিলা।
একই দিন যোগাযোগ করা হয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. এস এম যোবায়দুল কবিরের সাথে। কোয়েল পাখি মারা যাওয়ার বিষয়টি তার জানা নেই বলে এই প্রতিবেদককে জানান তিনি। একই দিন কথা হয় যুগ্ম সচিব ড. আবু নঈম মুহাম্মদ আবদুছ ছবুরের সাথেও। তিনিও বিষয়টি জানেন না বলে জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল সংখ্যক গবেষণার কোয়েল পাখি বার্ড ফ্লু বা এভিয়েন ইনফ্লুয়েন্সার এ মারা যাওয়ার পর মহাপরিচালক বা প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে ড. শাকিলা ফারুকের প্রথম দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইংকে জানানো। কিন্তু তা গোপন রাখেন তিনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সাভারের প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে সরেজমিন বিষয়টি দেখতে যান মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব ড. এস এম যোবায়দুল কবির। কেন বিষয়টি গোপন করা হলো তা মহাপরিচালকের কাছে জানতে চান। কিন্তু তিনি কোনো সদোত্তর দিতে পারেননি তাকে।
এ বিষয়ে গতকাল ড. এস এম যোবায়দুল কবির নয়া দিগন্তকে জানান, ৮০-৮৫টি কোয়েল পাখি মারা গেছে বলে আমাকে ডিজি জানিয়েছেন। পাখি মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন বলে জানিয়েছেন। আমি সেই প্রতিবেদন চেয়েছি। এটা পেলে জানা যাবে, আসলে কী কারণে কোয়েল পাখিগুলো মারা গেছে।