১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৬
`

ভ্যাটের হার বাড়ানো অবিবেচক কাজ : দেবপ্রিয়

আ’লীগের দুর্নীতির পেছনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এডিবিও দায়ী : আনু মুহাম্মদ
-


সম্প্রতি সরকার প্রায় একশ’টি পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাটের হার বাড়িয়েছে। এটাকে ‘অবিবেচনা প্রসূত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো ও সিটিজেনস প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজিএস বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, অবিবেচকভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। কর সংগ্রহ করতে হলে ক্রমান্বয়ে প্রত্যক্ষ করের কাছে যেতে হয়। আমরা প্রত্যক্ষ কর আহরণে কোনো পরিকল্পনা দেখিনি। যারা কর দেয় না তাদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেটা জানা গেলো না। আমাদের এটা চিন্তিত করেছে। আগামী গরমে জ্বালানি পরিস্থিতি আরো জটিল হবে বলে আশঙ্কা করছি।

গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিআইসিসির কার্নিভাল হলে ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ২০২৪’ আয়োজিত সিম্পোজিয়ামে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, পতিত আওয়ামী লীগের সীমাহীন দুর্নীতির পেছনে বিশ^ব্যাংক-আইএমএফ-এডিবিও দায়ী। তারা হাসিনার সরকারকে মদদ জুগিয়েছিল।
চামড়া ব্যবসায়ী নাসিম মঞ্জুর বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে সঙ্কট চলছে তা ৩৪ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে দেখেনি। অর্থনীতি এখন নাজুক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্যে রাখেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী প্রমুখ।

অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অর্থনৈতিক মেন্যুফেস্টো নেই মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যতটা মনোযোগ পাচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটা মনোযোগ পাচ্ছে না। অনেকেই বলছেন অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সরকার আগের সরকারের মতোই কাজ করছে। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা, প্রবৃদ্ধির ধারা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে আমরা যারা সংস্কারকে গতিশীল করতে চাই তারা ধৈর্যহারা হয়ে যাব। সংস্কারের পক্ষের মানুষগুলো অর্থনৈতিক অস্বস্তি ও নিরাপত্তার অভাব থেকে সুষম সংস্কারের পক্ষ থেকে সরে যেতে পারে।
রেকর্ড পরিমাণ আমন উৎপাদন করেও সংগ্রহ অভিযানে সাফল্য নেই জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সংগ্রহ অভিযানে আগে যেমন দুর্নীতি ছিল, তা এখনো আছে। কৃষক তার ফসলের মূল্য পাচ্ছে না। সামাজিক সুরক্ষা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আছে। এই সরকার কী ধরনের অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার রেখে যাবে প্রশ্ন তোলেন এই অর্থনীতিবিদ।

সুষম অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে যে ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো দরকার বা সংস্কার দরকার সেই রকমের কোনো রূপরেখা আমরা দেখলাম না, যোগ করেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সংশোধিত বাজেট দিতে পারেনি জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এটা না থাকার কারণে অন্যান্য বাজেটের কিছু সূচক পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। আগামী বাজেটকে কেন্দ্র করে সরকারের অর্থনৈতিক আলোচনা দরকার। প্রবৃদ্ধির ধার কমে গেছে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমেছে, কর্মসংস্থানে সমস্যা রয়ে গেছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া। দীর্ঘদিন ধরে টিসিবির পণ্যের দাম সমন্বয় করা হয়নি, ‘এটা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হতে পারে। আমরা রাজনীতিবিদ না। আমরা কি দীর্ঘমেয়াদে ১৭৫-১৮০ টাকায় তেল কিনে ১০০ টাকায় বিক্রি করবো? নাকি ১২৫-১৩০ টাকা করে এক কোটির জায়গায় দেড় কোটি বা দুই কোটি টাকায় প্রসারিত করবো এই চিন্তাগুলো আমাদের সাহসের সঙ্গে করতে হবে। যদি তা না করি তাহলে আমরাও একই বৃত্তে থেকে যাবো।’ তিনি বলেন, ‘এক কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করা হয়। এটাকে যখন ডিজিটাইজড করেছি তখন দেখেছি ৩৭ লাখ ভুয়া কার্ডধারী রয়েছে এখানে। বৃহৎ কিছু প্রতিষ্ঠান টিসিবির টেন্ডারে অংশ নিতে পারে। টিসিবির আকার, পেমেন্ট পলিসি, আর্থিক অবকাঠামো চলছে বাণিজ্যিক ঋণে, যা টেকসই নয়।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, তার জন্য বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রশংসাও দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, এসব সংস্থার প্রশংসা এবং অর্থায়ন শেখ হাসিনার সরকারকে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আরো শক্তি জুগিয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবি সাবেক সরকারের উন্নয়নের প্রশংসা করেছে এবং এটিকে ‘ডেভেলপমেন্ট মিরাকল’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তাদেরকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের সমর্থনই সরকারকে অনিয়ম ও লুটপাটে শক্তি জুগিয়েছে। এসব ঘটনার পেছনে দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।
এদের মধ্যে এক নম্বরে আছে বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া এডিবি সব প্রকল্পের মধ্যে আছে। আইএমএফ বিভিন্ন ধরনের প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে করাপশন বন্ধ করা, রিফর্ম করা; এগুলো ঠিক আছে। কিন্তু এগুলোর চেয়ে তারা বেশি আগ্রহী ভর্তুকি কমানো এবং জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে। আইএমএফের সুপারিশে ভর্তুকি কমানো ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ানোর নীতিমালা জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের তেমন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, ‘আইএমএফ তিন বছরে যে পরিমাণ ঋণ দেবে, দুই মাসেই তার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে। অথচ রেমিট্যান্স যারা পাঠায়, তাদের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বরং আইএমএফের পরামর্শে জনগণের ওপর বোঝা চাপানো হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, গত ১৫ বছরে উন্নয়নের গালগল্প শোনানো হয়েছে। সরকারি পরিসংখানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের মিল নেই। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কি কি চুক্তি হয়েছে তা আমাদের জানা দরকার। আমাদের শোষণ করা হয়েছে, ভারতের অঙ্গরাজ্যে আমাদের পরিণত করা হয়েছিল। সরকার এখনো এই বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেয়নি।’

তিনি বলেন, আমলাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে নানাভাবে, কিন্তু তারা কাঠামো নষ্ট করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। যারা টাকা পাচার করেছে, দেশের ভেতরেও আছে তাদের টাকা, সেখান থেকে টাকা উদ্ধার করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে খরচ করা উচিত বর্তমান সরকারের।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ‘সরকার কোনো একটি খাতকে গুরুত্ব না দিয়ে সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতকে গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করবে বলে আশা করি। ১০০ ইকোনমিক জোন হবে না, সরকারিভাবে সেটা পাঁচটিতে নামিয়ে এনেছি।
এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, দেশের অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিনিয়োগ অন্য দেশে চলে যাবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের এখনই আলোচনা করা দরকার। আমাদের প্রোডাকক্টিভিটি বাড়াতে হবে, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম কমানো প্রয়োজন।


আরো সংবাদ



premium cement