স্বৈরাচারের জননী উন্নয়নের আড়ালে চোরতন্ত্র তৈরি করেছিলেন
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৩১
পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে ‘স্বৈরাচারের জননী হিসেবে অভিহিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে স্বৈরাচারের জননী (শেখ হাসিনা) উন্নয়নের অনেক গল্প বানিয়েছিলেন। এই উন্নয়নের গল্পের আড়ালে তিনি চোরতন্ত্র তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পুরো পৃথিবী ঘুম থেকে উঠে তার অপরাধ দেখছে। মানুষ খুন, ব্যাংক ডাকাতি এবং অর্থপাচারের মতো বড় বড় অপরাধে তার সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসছে। আশা করছি, আইন প্রক্রিয়া মেনে দ্রুতই তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এসব কথা বলেন। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন : আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনে থাকা সব বিতর্কিত ধারা বাদ দিয়ে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। গণভবনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
শফিকুল আলম বলেন, নিশ্চিত থাকুন, নতুন যে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, এর মাধ্যমে সাইবারস্পেস যেমন সুরক্ষিত হবে। আমাদের সবার জন্য, ঠিক তেমনি এটি আমাদের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করবে। এটি কোনোভাবেই স্বাধীনতাকে সঙ্কুচিত করবে না। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, আপনারাও নিশ্চিত থাকতে পারেন। আগের সাইবার নিরাপত্তা আইনে যেসব বিতর্কিত ক্লজ (ধারা) ছিল, সেসব বাদ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৪ এর মূল বিষয় হলো আমরা সাইবার স্পেসকে সবার জন্য নিরাপদ করতে চাই। সাইবার স্পেসে অনেক ধরনের অপরাধ হয়, অনেকে প্রতারিত হন। মা-বোনেরা অনেক ধরনের বুলিংয়ের শিকার হন। শিশুদের অনেক ধরনের বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। সাইবার স্পেস নিরাপদ করা সরকারের দায়িত্ব।
শেখ হাসিনার আমলে করা সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারা ও অপপ্রয়োগ প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, আগের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টকে স্ক্র্যাপ করা হয়েছে। এটি এত বেশি বিতর্কিত, একে আসলে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ব্যবহার করেছেন ভিন্নমত দমন করার জন্য, কিংবা দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরির জন্য, কেউ যেন তার মতকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে না পারেন। তা পরিবর্তন করে এখন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ অনুমোদন করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার এবং কথায় কথায় গ্রেফতার করে ফেলার অপসংস্কৃতির পর প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে পরবর্তী সময়ে প্রণয়ন করা হয় ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’। কিন্তু সেটিরও বিভিন্ন ধারা-উপধারা নিয়ে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন বাপকভাবে আপত্তি জানিয়ে আসছিল।
প্রস্তাবিত নতুন খসড়ায় ‘সাইবার সুরক্ষা’ বলতে ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার ডেটা, ট্রাফিক ডেটা ও সাইবার স্পেসে ভৌত অবকাঠামোর সুরক্ষার পাশাপাশি ব্যক্তিগত, ব্যাংকিং বা ব্যবসায়িক তথ্যের সুরক্ষাকে বোঝানো হয়েছে, সাথে সাথে পোর্টাল বা নেটওয়ার্কে অনুমোদিত ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করাও বোঝানো হয়েছে।
খসড়ার শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ রহিতক্রমে সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সাইবার স্পেসে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন ও উক্ত অপরাধের বিচার এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত আইন।’
সাইবার স্পেসকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে আন্তঃসংযোগকৃত সব ডিজিটাল নেটওয়ার্কগুলোর ভার্চুয়াল জগৎ হিসেবে, যার মধ্যে ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগব্যবস্থা, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত, যেখানে সংঘটিত হয় ডেটা তৈরি, অ্যাকসেস, প্রেরণ, সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের অনলাইন কর্মকাণ্ড। ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার ডেটা, ট্রাফিক ডেটাও এটির অন্তর্ভুক্ত।
খসড়ায় রয়েছে ৯টি অধ্যায় ও ৫২টি ধারা। জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি, জাতীয় সাইবার সুরক্ষা কাউন্সিল, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, অপরাধ ও দণ্ড, অপরাধের তদন্ত ও বিচার ইত্যাদি নিয়ে রয়েছে আলাদা অধ্যায়। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত রাখার ব্যাপারে অবলম্বন করা হয়েছে সতর্কতা। বিশেষ করে জামিন অযোগ্য অপরাধগুলো যৌক্তিক রাখার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়।
শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে ইতোমধ্যে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বাংলাদেশ ফেরত চেয়েছে। এ বিষয়ে ভারতকে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, যত দ্রুত সম্ভব শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকে এ চেষ্টা জোরেশোরে চলছে। তবে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য একটা প্রয়োজনীয় সময়ের ব্যাপার। আমরা বারবার বলছি- শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত আনতে চাই। আশা করব ওনাকে দ্রুত দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে। তিনি বিচারের সম্মুখীন হবেন।
প্রেস সচিব বলেন, ‘আমরা দেখেছি গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার অপরাধগুলো কতটা ভয়াবহ ছিল। তিনি জানান, গুম কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ১৫ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ গুম হয়েছে। আইন-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। জুলাই বিপ্লবে মারা গেছে দেড় হাজার ছাত্র-জনতা। আরাফাত নামে গুলিবিদ্ধ ছয় বছর বয়সী মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যুকে স্মরণ করে শফিকুল আলম বলেন, একটা শিশুকে পুলিশ গুলি করেছে, কতটা ভয়াবহ। গত রোববার তার মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার শাসনামলে শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড, মাওলানা সাঈদীর রায়ের পরের হত্যাকাণ্ড। বিএনপি বারবার বলছে তাদের ৫০ থেকে ৬০ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ মামলা ছিল মিথ্যা। ৫০ লাখ মামলা যাদের নামে হয়েছে তাদের পরিবার অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের বিষয়ে শফিকুল আলম বলেন, সরকার তার দুর্নীতির বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে। তিনি কী পরিমাণ চুরি করেছেন, বাংলাদেশের মানুষ তা জানতে চায়। শেখ হাসিনা কিভাবে চোরতন্ত্র জারি করেছিল তার একটা চিত্র শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে। ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রতি বছর পাচার হয়েছে এবং ব্যাংকগুলো থেকে কিভাবে টাকা লুট হয়েছে তা সবার জানা। প্রেস সচিব বলেন, শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। সেই পিয়নের ব্যাংক তহবিলে ৬২৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।